যদি কারো অন্তরে আল্লাহর মহব্বত ও মহব্বতের প্রেরণা থাকে, তাহলে আল্লাহ তাকে মর্যাদামন্ডিত করেন। যেমন মর্যাদা লাভ করেছিলেন সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ যুল-বিজাদাইন (রাঃ)। তিনি ছিলেন একজন নওজোয়ান সাহাবী। মদীনার অতিদূরে এক বসতিতে থাকতেন। তিনি সঙ্গী-সাথী মারফত জানতে পারলেন, একজন নবীর আবির্ভাব হয়েছে। তিনি মনে মনে পরিকল্পনা করলেন, একদিন মদীনায় যাবেন এবং আগত নবীর সাথে সাক্ষাত করবেন।
সত্যি-সত্যিই একদিন তিনি মদীনায় চলে এলেন এবং কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলেন। ইসলাম গ্রহণ করে তিনি নিজের এলাকায় চলে এলেন। কিন্তু বাড়ি এসে কাউকে মুসলমান হওয়ার কথা জানালেন না। কারণ, তার বাড়ির সবাই কাফের ছিল। কেউ বিষয়টা জানতে পারলে নির্যাতনের আশঙ্কা ছিল। কিন্তু মহব্বত এমন এক জিনিস, যা কখনো চেপে রাখা যায় না। তিনি তার ইসলামের কথা গোপন রাখতে পারলেও, ঘরে-বাইরে কোথাও নবীজীর প্রসঙ্গে আলোচনা হলে তার প্রতি খুব আকৃষ্ট হতেন এবং সব কাজ ফেলে সেই আলোচনায় অংশ নিতেন।
মহব্বত তোমার থাকে না গোপন,
নামটি যখন তোমার কেউ করে স্মরণ।
হযরত আব্দুল্লাহ (রা.) মুখে কিছু প্রকাশ না করলেও হাবভাব তিনি গোপন করতে পারলেন না। তার আচার-আচরণে বাড়ির লোকদের মনে গভীর সন্দেহ জন্মাল। একদিন তার পিতা সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি নতুন ধর্মমত গ্রহণ করেছ? তিনি জবাবে বললেন, হ্যাঁ। পিতা বললেন, তোমার সামনে দুটি রাস্তা খোলা আছে। এখন যে রাস্তা ইচ্ছা তুমি অবলম্বন করো। নতুন ধর্মমতের উপর থাকলে এখনই এ ঘর থেকে বেরিয়ে যাও। আর যদি এ ঘরে থাকতে চাও, তাহলে আমাদের পুরাতন ধর্মমতে আবার ফিরে আস।
তিনি পিতার প্রস্তাবে তখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পিতাকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন, ঘর-বাড়ি ছাড়তে পারি; কিন্তু আল্লাহর দ্বীন বর্জন করতে পারি না।
চাচা তাঁকে এর জন্য অনেক মারপিট করলেন। এমনকি বাড়ি হতে তাড়িয়ে দেওয়ার সময় শরীরের পোশাকও খুলে রেখে দিল। তিনি একেবারে উলঙ্গ হয়ে গেলেন। মা চাচার সামনে কিছুই বললেন না। কিন্তু চাচা চোখের আড়াল হয়ে গেলে তার মা তাকে একটা চাদর দিয়ে বললেন, এটা দ্বারা সতর ঢেকে ফেলো। তিনি বাড়ির বাইরে এসে চাদরটা দুই টুকরা করলেন। এক টুকরা দ্বারা সতর ঢাকলেন আর অপর টুকরা গায়ে জড়িয়ে রাখলেন। এ কারণে তিনি ‘যুল-বিজাদাইন’ তথা চাদরওয়ালা উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।
বাড়িছাড়া হয়ে এখন তিনি যাবেন কোথায়? নিজের অজান্তে তিনি মদীনার পথ ধরলেন। সারা রাত সফর করে সকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সকাশে এসে উপস্থিত হলেন। নবীজি তাকে দেখে খুশি হলেন। সেই খুশির আভা নবীজির সারা চেহারায় ছড়িয়ে পড়ল। সাহাবায়ে কেরামের মনে কৌতুহল জাগল, এই লোকটা আবার কে, যাকে দেখে নবীজির চেহারা খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠেছে?
উভয় জগত যেন কার মহব্বতে মজেছে,
চিন্তার রাত পেরিয়ে সে এসেছে।
হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ) নবীজির খেদমতে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রসূল! সব কিছু ছেড়ে এসেছি। আপনার চরণতলে একটু ঠাঁই চাই। নবীজি তাকে সানন্দে বরণ করে নিলেন এবং তাকে ‘আসহাবে সুফফা’র সদস্য করে নিলেন। তিনি সুফফাবাসীদের সঙ্গে অবস্থান শুরু করলেন।
যেহাতু তিনি বিরাট কুরবানী দিয়েছিলেন, আল্লাহর মহব্বতের সব কিছু বিসর্জন দিয়েছিলেন, তাই এর প্রতিদানও হওয়া দরকার ছিল বিশাল। তার মধ্যে আল্লাহর ভালবাসা এর প্রবল ছিল যে, মাঝে-মধ্যে তার মাঝে অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি হয়ে যেত। বর্তমানে কেউ-কেউ জিজ্ঞাসা করে ‘অস্বাভাবিক অবস্থা’ আবার কি? তাদের বলি, হাদীস পড়ুন; তাহলে জানতে পারবেন, কতক সাহাবার মধ্যেও ‘অস্বাভাবিক অবস্থা’ সৃষ্টি হত।
হাদীসে এসেছে, হযরত আব্দুল্লাহ যুল-বিজাদাইন (রা.) মাঝে-মধ্যে মসজিদে নববীর দরজায় বসে থাকতেন এবং তার মধ্যে এমন ‘হালত’ পয়দা হত যে, তিনি উচ্চস্বরে ‘আল্লাহ, আল্লাহ’ বলে উঠতেন। হযরত উমর (রা.) তাঁকে একদিন এই অবস্থায় দেখে খুব রাগ করলেন। একথা শুনে নবীজি উমর (রা.) কে বললেন, উমর! আব্দুল্লাহকে কিছু বলবনা। সে যা কিছু করছে, সবই ইখলাশের সাথে করছে।
এর কিছুদিন পরের ঘটনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক যুদ্ধে গমন করেন। হযরত আব্দুল্লাহ (রা.)-ও নবীজির সঙ্গে ছিলেন। পথিমধ্যে একস্থানে হযরত আব্দুল্লাহ (রা.)-এর জ্বর হলো। নবীজি খবর জেনে হযরত আবু বকর (রা.)-এর ও ওমর (রা.) কে সঙ্গে নিয়ে তাকে দেখতে এলেন। তখন হযরত আব্দুল্লাহ (রা.)-এর জীবনের সামান্য সময় বাকি ছিল। নবীজি এসে তার মাথা নিজের কোলে টেনে নিলেন। তিনিই এমন খোশনসীব সাহাবী, যার দৃষ্টি নবীজির চেহারার পানে দীর্ঘ সময় ধরে নিবদ্ধ ছিল আর এই অবস্থায় জীবনের শেষ সময় পার করছিলেন। সুবহানাল্লাহ! মাথা নবীজির কোলে থাকাবস্থায় তার ইন্তেকাল হয়ে গেলো।
নবীজি নির্দেশ দিলেন, আব্দুল্লাহর দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করো। নবীজি স্বীয় চাদর পাঠিয়ে বললেন, আব্দুল্লাহকে এই চাদরে কাফন পরিধান করাও। সুবহানাল্লাহ! হে আল্লাহ! তুমি কেমন প্রতিদানদাতা যে, যে শরীরকে একদিন তোমার রাস্তায় নগ্ন করা হয়েছিল, আজ সেই শরীরকে তুমি স্বীয় মাহবুব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাদর দ্বারা ঢাকার ব্যবস্থা করে দিলে! সুবহানাল্লাহ! যারা আল্লাহর জন্য কষ্ট স্বীকার করে, আল্লাহ তাদের উত্তম বিনিময় দান করেন।
কাফন পরানোর পরে নবীজি তার জানাযার নামায পড়ালেন এবং নামাযের পরে জানাযা নিয়ে কবরস্থানে গেলেন। শরীয়তের মাসআলা হলো, যে ব্যক্তি মৃতের সবচেয়ে ঘনিষ্ট আত্মীয়, সে মৃতকে কবরে নামাবে। সেখানে হযরত আবু বকর (রা.) এবং হযরত উমর (রা.)ও ছিলেন। কিন্তু নবীজি স্বয়ং কবরে নেমে বললেন, তোমাদের ভাই আব্দুল্লাহকে ধরে আমার কাছে দাও। অবশ্যই তার সম্মানের প্রতি খেয়াল রাখবে। অতঃপর নবীজি আল্লাহর এই সত্য-প্রেমিককে নিজের হাতে তুলে নিলেন এবং জমিনে শুইয়ে দিলেন, যেন স্বীয় আমানত জমিনে অর্পণ করলেন।
হাদীসে আছে, যখন নবীজি হযরত আব্দুল্লাহ (রা.) কে জমিনে রাখলেন, তখন বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আব্দুল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, তুমিও তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে যাও।’ এটা এমন কথা ছিল, যা শুনে হযরত উমর (রা.)-এর মতো লোকের মধ্যে কঠিন ভাবাবেগ সৃষ্টি হয় এবং তিনি বললেন, আমার মন চায়, যদি নবীজির মুবারক হাতে তার স্থলে আমার লাশ হত! (খুতবাতে জুলফিকার ৩/৩৩-৩৬)
আপনি পড়ছেনঃ আল্লাহ ওয়ালাদের হৃদয় ছোঁয়া ঘটনাবলী বই থেকে।
The post হযরত আব্দুল্লাহ যুল-বিজাদাইন (রাঃ) ও আল্লাহ প্রেম appeared first on Amar Bangla Post.