নববিবাহিত বধূর যখন বমি হয়, তখন পরিচারিকা বা অন্যান্যদের মাধ্যমে খবর সারা সংসারে চালাচালি হয়ে যায় যে, বধূমাতা হয়তো গর্ভধারণ করেছেন। আর রাজা-জমিদার বাড়িতে হলে তো কথাই নেই। রাণীমা বা যুবরাণীর বমিকেন্দ্রিক বাড়িতে আনন্দ-উচ্ছাসের ঢল নেমে যায়। মিষ্টি বিতরণ থেকে শুরু করে ফুলমালা মঙ্গলদ্বীপ ও ধূপের আর্তির সঙ্গে শাহনাই –রোশনাইয়ে জাকজমক পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
তবে বমির মাত্রা যখন মাত্রাতিরিক্ত হতে থাকে, তখন বধূর শরীর স্বাস্থ্য এক্কেবারে ভেঙ্গে পড়ার মতো হয়ে দাঁড়ায়। সে কাহিল হয়ে পড়ে। মুখে খাওয়ার নানা ধরনের ওষুধ কোনো কাজে লাগে না। এমনকি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় প্রথম দিকেই মাকে হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে ভর্তি করা জরুরি হয়ে পড়ে। খাওয়া দাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে শিরা দিয়ে গ্লুকোজ, ভিটামিন ও যাবতীয় ওষুধ সঞ্চালন করা জরুরি হয়ে পড়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এতেও কাজ না হলে এবং রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে গর্ভমচন করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা থাকে না।
-
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমি কাকে বলেঃ
অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় যখন এত বেশি বমি হয় যে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় নারীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় এবং তাঁর দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যাহত হয়, তাঁকে গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমি বা Hyperemesis gravidarun বলে। এক হাজার গর্ভের ক্ষেত্রে প্রায় এক জনের এই রোগ হয়।
- আনুষাঙ্গিক বিষয়ঃ
সাধারণর গর্ভের প্রথম তিন মাস পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি থাকে।
সচরাচর প্রথম গর্ভের ক্ষেত্রেই এই রোগ দেখা যায়।
পরিবারের ইতিহাস নিলে দেখা যায়, রোগির দিদি বা বোন বা মায়েরও গর্ভাবস্থায় এইরকম সমস্যা হয়েছিল।
যজম গর্ভ বা মোলার প্রেগনেন্সি থাকলে এরকম সমস্যা হওয়ার বিপদ বেশি।
আবার অনেক বিশেষজ্ঞ এই রোগের যে-যে কারণের কথা উল্লেখ করেন, তা হল—
অতিমাত্রায় এইচ.সি.জি হরমোন সৃষ্টিও হওয়া।
ভিটামিন-বি১, বি৬, এবং প্রোটিনের অভাবজনিত কারণ।
মানসিক কারণ।
রোগবিদ্যা (Pathology):
এই রোগ হলে শরীরে যে-যে পরিবর্তন ঘটে, তা হল এইরকম—
ব্রেনঃ ব্রেনের হাইপোথ্যালামাসে অল্পমাত্রায় রক্তক্ষরণ হতে পারে।
হার্টঃ এন্ডোকার্ডিয়ামের তলায় রক্তক্ষরণ হতে পারে।
লিভারঃ ফ্যাতী ইনফিলট্রেশন হতে পারে।
কিডনিঃ কিডনির কোষে ফ্যাটি পরিবর্তন হতে পারে।
এই রোগের জন্য শরীরে Biochemical পরিবর্তন
অতিমাত্রায় বমির জন্য শরীর থেকে পানি এবং লবন বেরিয়ে যায়, যার ফলে রক্তে সোডিয়াম, পটাসিয়াম ও ক্লোরাইডের মাত্রাও কমে যায়। রক্তে ইউরিয়া এবং ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রাও বেড়ে যায়। রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে জনডিস দেখা দিতে পারে।
উপসর্গঃ
প্রথমদিকেঃ রোগীর শুধুমাত্র বেশি বেশি বমি হয়। রোগীর দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয় না। রক্তপরীক্ষা করেও কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না।
পরের দিকে বেশিদিন ধরে এ রোগে ভোগার পরঃ বমি উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে। রোগীর বিছানা থেকে উঠে বসার মতো শক্তিও লুপ্ত হয়। প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়। কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। ওপরের পেটে ব্যথা হয়। রোগীর চেহারা শুঙ্ক দেখায়। ওজন কমে যায়। চোখ ভেতরে ঢুকে যায়। জিভ শুকনো দেখায়। নাড়ির গতি ১০০ বা তারও বেশি হয়। রক্তচাপ কমতে পারে। শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। জন্ডিস দেখা দিতে পারে।
চিকিতসাঃ
- রোগীকে হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হবে। বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, রোগীকে গৃহ থেকে স্থানান্তরিত করার পরপরই বমি কমে বা বন্ধ হয়ে যায়। হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে। তাড়াতাড়ি ভালো ফল পেতে হলে আত্মীয়স্বজন, এমনকি তাঁর স্বামীকেও রোগীর সঙ্গে সাক্ষাতে বিরত হতে হবে।
- রোগীর মুখ দিয়ে সব খাওয়া বন্ধ। আই.ভি. গ্লুকোজ এবং রিঙ্গার সলিউশন ২৪ ঘন্টায় ৫-৬ টি বোতল দিতে হবে। এর সঙ্গে ২৪ ঘন্টায় একটি ফ্রুক্টোডেক্স দিলে ভালো হয়। ফ্লুইড ইনটেক-আউটপুট চার্ট অনুসরণ করতে হবে।
বমি বন্ধ করার ওষুধঃ Inj, Phenargan-25mg, আট ঘন্টা বাদে বাদে অথবা Inj.Espazine-1mg বারো ঘন্টা বাদে বাদে দিতে হবে।
রোগীর উন্নতি পরিলক্ষিত হয় যখন—
- বমি বন্ধ হয়।
- রোগীর চেহারা ভালো হয়।
- জিভে ভিজে ভিজে ভাব আসে।
- শরীর থেকে অ্যাসিটোনের গন্ধ দূর হয়।
- খিদে অনুভূত হয়।
- নাড়ির গতি হ্রাস এবং স্বাভাবিক হয়ে যায়।
- প্রস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
খাদ্যঃ বমি বন্ধ হলে রোগীকে প্রথমে প্রথমে শুকনো কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য, যেমন—বিস্কুট, টোস্ট, রুটি ইত্যাদি দেওয়া হয়। অল্প অল্প করে বারে বারে খাদ্য দেওয়া হয় দিনে ছ-সাত বার। এরপর স্বাভাবিক পুরো খাবার দেওয়া যেতে পারে। যখন শুকনো খাবার দাবার খাওয়ার পরও বমি হয় না তখন I.V. drip বন্ধ করা হয়।
এই রোগের জন্য কখন গর্ভপাত করার প্রয়োজন হয়?
- যখন রোগীর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হয় চিকিৎসা চলা সত্ত্বেও।
- যখন নারীর গতি ১০০-র বেশি ক্রমশ বাড়তে থাকে।
- যখন শরীরের তাপমান ক্রমবর্ধমান হয়।
- প্রস্রাবের পরিমাণ যখন কমতে থাকে এবং প্রোটিন নির্গত হয়।
- সর্বোপরি যখন জন্ডিস দেখা দেয় এবং স্নায়ু সংক্রান্ত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
গর্ভপাতের পদ্ধতিঃ
১২ সপ্তাহের নিচেঃ সাকশন ইভাকুয়েশন প্যারাসারভাইক্যাল ব্লক করে।
১২ সপ্তাহের বেশিঃ অ্যাবডমিনাল হিসটেরোটমি। Local anaesthesia দিয়ে করতে পারলে বেশি ভালো।
লেখকঃ ডাঃ অবিনাশ চন্দ্র রায়।
লেখকেরঃ গর্ভবতী মা ও সন্তান বই থেকে।
The post গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমি হওয়ার কারণ ও চিকিৎসা appeared first on Amar Bangla Post.