যে সামাজিক ব্যবস্থা অবশ্যম্ভাবী পতনের সম্মুখীন তাঁর প্রধান ও পরিণত লক্ষণসমূহের একটি হল নারীর নিরাপত্তাহীনতা এবং একই সাথে সমাজে নির্লজ্জ, নিরাবরণ ও অবাধ বিচরণশীলা নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি। এখানে আমরা বিধিবদ্ধ বেশ্যাবৃত্তির কথা উল্লেখ করিনি। বিধিবদ্ধ ও প্রকাশ্য বেশ্যাবৃত্তি আইন দ্বারা বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও অপ্রকাশ্য বেশ্যাবৃত্তি অপ্রতিরোধ্য। ধনতান্ত্রিক সমাজে নারী হল পণ্য। নারীর রূপকেও মনোহারী দোকানের জিনিসের মত হাতে নিয়ে পরখ করে উল্টেপাল্টে পছন্দ করে কেনা যায়। বাংলাদেশকে আধা সামস্ততান্ত্রিক ও আধা পুঁজিবাদী দেশ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এখানে নারী স্বাধীনতা, নারীশিক্ষা ও নারীর জীবিকা অর্জনের সমকক্ষতার কথা যতই বলা হোক না কেন, মেয়েরা বাংলাদেশে নিরাপদ সামাজিক জীব নয়। তাঁদের শরীর ও সতীত্ব রক্ষার জন্য বাংলাদেশের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় রীতিনীতিকে সম্প্রতি আর যথেষ্ট বিবেচনা করা যাচ্ছে না। নারীর সতীত্বের ওপর হামলার যে সমস্ত খবরাখবর অহরহ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তা যদি কোনো সমাজবিজ্ঞানী নিবিষ্ট চিত্তে পাঠ করেন এবং এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আবিস্কারে গবেষণায় নিরত হন তবে চোখে অন্ধকার দেখা ছাড়া তাঁর আর কোন গত্যন্তর আছে বলে মনে করি না।
সম্প্রতি বাংলাদেশের গ্রাম জনপদে নারী লাঞ্চনার যে তরঙ্গ উঠেছে তা সামাজিক ও ধর্মীয় কারণেই এক ভয়াবহ দুশ্চিন্তার বিষয়। মনে হয় বিত্তিহীন চাষী পরিবারের গৃহবধূরা, যুবতী ও কিশোরীরা শুধু নারী হওয়ার কারণেই যেন একশ্রেণীর লোকের চোখে অত্যন্ত সুলভ। তাঁদের সতীত্বের কোনো সামাজিক মূল্য আছে বলে তাঁরা মনে করে না। এতদিন নারীর সতীত্বের ও শ্লীলতার ওপর হামলা সাধারণত শহরাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। দুয়েকটা ছিটেফোঁটা ঘটনা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ঘটলেও এর সুষ্ঠু সুবিচার ছিল সকলেরই স্বস্তি ও শান্তির কারণ। সম্প্রতি এই স্বস্তি ও শান্তি দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। আইনের শিকড় গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছলেও সুবিচার এখনও নদী পার হয়নি। সে পারঘাটে খেয়া নৌকার আশায় নিরুপায় হয়ে মাথা কুটছে।
প্রশাসন উপজেলা পর্যন্ত তাঁর ডালপালা মেলাতে আমরা আনন্দিত। নিঃসন্দেহে এই পদক্ষেপ একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ। তবে অনেক সমস্য বিপ্লব তেমন কোনো সুফল বয়ে আনে না যদি না এই বিপ্লবের সাথে সাধারণ মানুষের জন্য মঙ্গল ও সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য সক্রিয় থাকে। প্রশাসন ব্যবস্থার প্রধান নির্ভরতা সৃষ্টি হয় জনগণকে নিরাপত্তা দানে। এই নিরাপত্তার আসল দাবীদার সাধারণ মানুষ ও গ্রাম জনপদের সহায়কসম্বলহীন মানুষ যারা পরের জমিতে, পরের খামারে ও পরের ঘর-গেরস্থালীতে নিত্য শ্রমের বিনিময়ে নিজেদের ভরণ-পোষণ করে থাকে। প্রশাসন যদি হয় গ্রামের জুলুমবাজদের সহায়ক শক্তি তবে প্রশাসনিক বিপ্লবের পরিবর্তে উপজেলায় পচা প্রতিক্রিয়াশীলতাঁর সম্প্রসারণই ঘটানো হবে।
আমরা অস্বীকার করি না উপজেলা পর্যন্ত প্রশাসন ব্যবস্থা এর হাত বাড়ানোর সাথে সাথে সারা বাংলাদেশ একটা নাড়া খেয়ে উঠেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঔপনিবেশিক অবজ্ঞার ফলে বাংলাদেশের আসল ভিত্তিমূল আটষট্টি হাজার গ্রাম হকচকিয়ে গেছে। আশার বাতাসে সচকিত গ্রাম জনপদ। যেন কোটি কোটি নির্যাতিত মানুষ সমস্বরে চিৎকার করে উঠতে চায়, আমরা আমাদের ওপর হাজার হাজার বছর ধরে জমে থাকা অবিচার, অন্যায়-ক্ষুধা ও অবদমনের বিচার চাই। বিচার চাই লুণ্ঠন ও ধর্ষণের। বিচার চাই জমি বেহাত হওয়ার। বিচার চাই জাল দলিলের সাহায্যে ও গায়ের জোরে পেষণের কবলে ফেলে নিঃস্ব করে দেয়ার মত জুলুমের। যেদিন উপজেলা প্রশাসন ঐসব ‘মোকদ্দমার’ সত্যিকার সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে সেদিন শুরু হবে বিপ্লব। তখন বিপ্লব বলে চিনতে অন্যের সাহায্য নিতে হবে না।
যা হোক একটি বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে আমরা প্রসঙ্গান্তরে চলে গেছি। আমাদের আলোচ্য বিষয় ছিল বাংলাদেশের গ্রাম জনপদের বিত্তহীন পরিবারের নারী সমাজের নিরাপত্তাহীনতা। বর্তমানে বাংলাদেশের পল্লী প্রান্তরে নারীর সতীত্বের অসম্মান এক অসহনীয় পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। যেখানে সেখানে নারী ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, হত্যা ও অঙ্গহানির জোয়ার বইছে। আমরা জানি এসব দুস্কর্মের সবগুলোরই শেষ পর্যন্ত বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাবার ক্ষমতা অত্যাচারিত শ্রেণীর সাধ্যের বাইরে। তবুও এর একটা বিহিত ব্যবস্থা সমাজের জন্য অপরিহার্য বলে আমরা মনে করি। আমরা মনে করি সম্প্রসারিত প্রশাসন ব্যবস্থা আগুয়ান হয়ে নারীর সতীত্বের নিরাপত্তার গ্যারান্টি সৃষ্টি করতে পারলে সামাজিক ন্যায়নীতি যা এতদিন মোটামুটি প্রচলিত ছিল তা খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচবে। আগে গ্রাম্য বিচার বা গ্রাম প্রধানদের সালিশী গ্রাম্য সমাজকে যে নিরাপত্তা দিত তা এখন অবলুপ্তির পথে। প্রশাসন উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হওয়ায় ঐসব গ্রাম্য বিচার বর্তমানে উৎসাহহীন। তাছাড়া গ্রাম্য বিচার ব্যবস্থা ও নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে স্বার্থপরতার পঙ্কে নিমজ্জিত। এদের প্রতি এখন আর সাধারণ মানুষের তেমন আস্থাও অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। এমতাবস্থায় অসহায়ের সহায় কে হবে?
সম্প্রতি জাতীয় সংবাদপত্রসমূহে প্রকাশিত নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন পরিবারের গৃহবধূদের জোরপূর্বক ধর্ষণের কয়েকটি খবরে বাংলাদেশের গ্রাম-সমাজের আভ্যন্তরীণ বিকৃতির একটা হৃদয় বিদারক চিত্র চিন্তাশীল মানুষদের দারুণ অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলবে বলে আমরা আশঙ্কা করি। সংবাদগুলোর সারসংক্ষেপ করলে এই দাঁড়ায়-গাইবান্ধার উপজেলা পলাশবাড়ির রণবাসপুর গাঁয়ের গুলজার হোসেনের স্ত্রী নূরুননাহারকে কয়েকজন দৃঙ্কৃতকারী বাড়ী থেকে ডেকে নিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। লালমনিরহাট জেলার সাহাব পাড়ার দুলালী বেগম লাভলীকেও কয়েক ব্যক্তি জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। আরেক দুলালী বারো বছরের মেয়ে, মিঠাপুকুর নিবাসী চাচার সাথে নবাবগঞ্জ যাওয়ার পথে কয়েক ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষিত হয়। তালা উপজেলার নালতা গ্রামের গৃহ-বধূ মরিয়ম বেগমকে এক ব্যক্তি স্ত্রীর অসুস্থতার জন্য সেবা করার ছলনা করে নিয়ে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে আর কয়েকজনসহ শ্লীলতাহানি করে। পটুয়াখালীর পল্লীতে জৈনকাঠি গ্রামের মনোয়ারা বেগম স্বামীর বাড়ী থেকে বাপের বাড়ী যাওয়ার পথে তিন ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষিতা হয়।
এই হল জোরপূর্বক গ্রাম বধূদের সতীত্বহানি ও পক্ষকালের সংক্ষিপ্ত সার। এ থেকেই বর্তমানে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ সামাজিক বিকৃতির একটা সাদামাটা চিত্র পাওয়া যায়। এই চিত্রের সামগ্রিক ভয়াবহ দিকটা আরও কত মর্মান্তিক তা সহজেই আন্দাজ করা যায়।
আমরা মনে করি সামাজিকভাবে আমরা এক ভুল পথের যাত্রী। আধুনিক সামাজিক ব্যবস্থা যার বীজ পাশ্চাত্য অর্থাৎ ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী সমাজের ঐতিহ্য লালিত তা ক্রমাগত আমাদের সমাজ তথা গ্রামের গভীরে প্রবেশ করে দেশকে ফতুর করে দিতে উদ্যত হয়েছে। আধুনিক শার্টপ্যান্টের মত তা আমাদের যুব মানসকে সম্পূর্ণভাবে বশীভূত করে ফেলেছে। ফলে দেখা দিয়েছে এক ধরণের অস্থিরতা। এই অস্থিরতার যেহেতু কোনো আদর্শ নেই। মানবিক দায়িত্ববোধের প্রতি নেই সম্মান। যার ফলে যুবমানস আজ উদ্দেশ্যবিহীন উন্নাসিকতায়, যৌনতায়, অপকৃষ্ট রুচিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত। আমাদের গ্রাম সমাজের শিকড় আগেই পচে গিয়েছিল। এখন বিলোপের আগে এর দুর্গন্ধ সকলের পক্ষেই তিষ্টানোর দায়।
আমরা মনে করি এই অবস্থা থেকে দেশ, জাতি ও সমাজ কাঠামোকে রক্ষা করতে হলে ইসলামী নীতিবোধ আবার গ্রামে গ্রামে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আলেমদের সম্মানকে ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রবর্তন করতে হবে ব্যাপকভাবে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার এবং পর্দার। পাশ্চাত্য সভ্যতায় ফতুর হয়ে সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে পাশ্চাত্য ঘেঁষা দেশও আবার পর্দার কথা চিন্তা করছে। নারীর সম্মান একমাত্র পর্দাই যে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম একথা আজ সমস্ত বিরুদ্ধতার মুখেও উচ্চারণ করার নামই সম্ভবত জেহাদ। এই জেহাদ বাংলাদেশের কব্র শুরু হবে?
লেখকঃ আল মাহমুদ। ২২/৪/৮৫
ব্লগ থেকে আরো পড়ুন…
০১। সতীত্ব কি শুধু নারীদের জন্য?
০২। নারীরা কি পুরুষের ভোগের বস্তু?
০৪। সতীত্বের মূল্য ৬০ হাজার টাকা?
০৫। সতীত্বের নিলাম
The post বেশ্যা বৃত্তির রকমফের | আল মাহমুদ appeared first on Amar Bangla Post.