সংবাদপত্র খুললেই হত্যা, ছিনতাই, সড়ক দুর্ঘটনার কোনো কোনো সংবাদে পাঠকদের মেজাজটা ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে, মনে হয় জিভের ওপর একটা অস্বস্তিকর তেতো স্বাদ কে যেন জোর করে ছড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক মানবিক মাতা-মমতার বন্ধন যদি না থাকে তখনই হতাশার কালো অন্ধকার দেশকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে বাধ্য। এই অন্ধকারের বাসিন্দারাই অতিশয় সামান্য স্বার্থপরতার কারণে, যে কারণ স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনার মানুষের কাছে অতিশয় তুচ্ছ, পরস্পরকে হত্যা করতে পারে। এমন কি অল্প বয়স্ক কিশোর তাঁর কিশোরী সহপাঠিনীকে বাগে পেয়ে প্রেমে সাড়া না দেয়ার অপরাধে পাট ক্ষেতে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করতে পারে। পারে ব্যর্থ প্রেমিক তাঁর নারাজ প্রেমিকার মুখে এসিড নিক্ষেপ করে তাঁকে চিরকালের মট পঙ্গু করে দিতে। এই সবি হল উপযুক্ত শিক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের যথোপযুক্ত অভাবের দরুন একটি শিশুর মনে যে হতাশা ও পাশবিকতা দেখা দেয় তার বয়ঃসন্ধিকালীন আকস্মিক বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশের কোন পরিবারই এখন এই মূল্য বোধের পতনের হাত থেকে প্রকৃত অর্থে মুক্ত নয়। একজন কিষাণ সন্তানের মধ্যে যে যে কর্তব্যবোধ শ্রমের প্রতি নিষ্ঠা ও পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতি দায়িত্ববোধ অবচেতন মনে একদা কাজ করতো আজ আর তা তেমন সতেজ নয়। একজন শিক্ষকের সন্তানের মধ্যে একদা লেখাপড়া, জ্ঞান ও বিদ্বানের প্রতি সম্মান দেখানোর যে অভ্যাস ছিল, অভ্যাস ছিল দেশ ও দশের প্রতি দায়িত্ববোধের, আজ তাঁর চিহ্নমাত্র ঐ সমস্ত পরিবারের আচরণীয় বিষয় নয়। মূল্যবোধের অবক্ষয় কাকে যে কোথায় ছিটকে ফেলতে চাইছে, সামাজিক কোন পরিবর্তন বা স্থিতিশীলতা যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজ কাঠামোকে সুস্থির না করবে ততদিন বাংলাদেশের প্রতিটি প্রভাত আমাদের জন্য নিয়ে আসবে দুর্ঘটনার সংবাদ। চলতে থাকবে ছিনতাই, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও এসিড নিক্ষেপের ভয়ার্ত কাহিনী। আমরা বুকে হাত রেখে হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি শুনতে শুনতে প্রায় প্রত্যহ তা পাঠ করতে করতে একদিন স্বাভাবিক হয়ে যাব।
গত পরশু সকালের পত্রিকার প্রথম পাতার অস্বস্তিকর সংবাদগুলোর মধ্যে দু’টি শিশুকে দু’টি মাত্র সোনার দুলের জন্য পানিতে চুবিয়ে হত্যার বিবরণ এতই হৃদয়বিদারক যে, অনিচ্ছায়, ভয়াবহ এক অস্বস্তির মধ্যে সংবাদটি পাঠ করে সারাটা দিন মনের ওপর একটা দুর্ভর চাপ নিয়ে নিজের কাজকর্ম করে গেছি। অনুভূতিশীল মানুষ প্রায় প্রত্যহই এ ধরনের মানসিক প্রেসারের মধ্যে জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে।
আমাদের সব মূল্যবোধই যখন এক এক করে পাল্টে যাচ্ছে, তখনও কিন্তু কয়েকটি কুসংস্কার পাল্টায়নি। যেমন সোনার অলংকার ধারণ। উজ্জ্বল ধাতু হিসাবে সোনাকে অত্যধিক মূল্য দেয়া। বিয়ে-শাদীতে সোনাকে লেনদেনের বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা ইত্যাদি। পৃথিবীতে কোথাও এই উপমহাদেশের মট সোনার অলংকার পরার রেওয়াজ নেই। অতীতে থাকলেও এখন উঠে গেছে। ইউরোপ-আমেরিকায় কোনো নারীই সোনার অলংকারকে তাঁর রূপ সৌন্দর্যের সহযোগী মনে করেন না। তাঁরা যে কোনো উজ্জ্বল কমদামের ধাতুর গয়নাতেই সন্তুষ্ট। সোনা যেহেতু সব সময় শয়তানের লালসা-লোভকেই চাঙ্গা করে তোলে; তাছাড়া দামী ধাতু বয়ে বেড়ানো চিরকালই বিপজ্জনক সে কারণে পাশ্চাত্যের বুদ্ধিমতী নারীরা বহু আগেই সোনাকে অলংকার ধাতু হিসেবে পরিত্যাগ করেছে। পাথরের, লোহার, নিকেলের অলংকারই বর্তমানে শ্বেতাঙ্গিনীদের শোভা বৃদ্ধির সহায়ক শক্তি হিসাবে পরিগণিত।
বাংলাদেশে সোনা প্রতি মুহুর্তে নানাবিধ অঘটনের কারণ বা জন্মদাত্রী। প্রায় প্রত্যহই বেআইনিভাবে বিদেশ থেকে সোনা আনার ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। চোরাপথে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সোনা আনতে গিয়ে কাস্টমের হাতে ধরা পড়ার সচিত্র খবর দেখে দেখে ভাবি, এই ধরা পড়ার জন্য যে পাচারকারীরা খুব বিব্রত তা মনে হয় না। আমাদের কাছে যা লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যাপার, পাচারকারীদের কাছে তা কিছুই নয়। এ যেন এক ধরনের অবজ্ঞাপ্রসুত ব্যাপার। তা না হলে গত কয়েক মাসে বিমানবন্দরে কাস্টমস যে তাল তাল সোনার বেআইনি আমদানী হাতেনাতে ধরলো, তাতে কি গোল্ড স্মাগলিং বন্ধ হয়েছে বলে মনে হয়? আমাদের তো তা মনে হয় না। মনে হয় সোনার যে কুসংস্কার সারাটা দেশকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে তা যতদিন উপশম না হবে ততদিন সোনার মূল্য কমবে না।
সোনা ছাড়া বিয়ে হয় না। আগেই জেনে নিতে হয়, কনের শরীরে কত ভরি সোনা সেঁটে দেওয়া হয়েছে। জড়োয়া যে সব সময় মানুষের শরীরকে সুন্দর করে তোলে এমন কোনো কথা নয়, তবুও বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়ে ভাবে, স্বপ্ন দেখে তাঁর গা ভরা গয়না। অধিকাংশ মেয়েকেই যে সোনার গয়নায় কুৎসিত দেখায় এটা কুসংস্কারের জন্য কেউ বলতে পারে না। যদিও আর্থিক কারণে সবাই আশ মিটিয়ে সোনার অলংকার প্রতে পারে না, তবুও সোনার কোনো কিছু পেলেই তা শরীরে ধারণ করার একটা জঘন্য অভ্যেস বাঙ্গালি নারীরা আজও ত্যাগ করতে পারেনি। অবশ্য শহর অঞ্চলে দু একটি পাশ্চাত্য শিক্ষিত পরিবার থেকে সোনার অলংকারের অভ্যেস একটু একটু উঠে যাচ্ছে বলে মনে হয়।
গত পরশু সংবাদপত্রে দু’টি শিশু হত্যার ঘটনার বলা হয়েছে, খুলনার খালিশপুরের এক গৃহ পরিচারিকা এক আনা ওজনের কানের দুলের জন্য পাশের বাড়ীর এক ভদ্রলোকের মেয়ে ও নাতনীকে, যাদের বয়স মাত্র চার কিম্বা পাঁচ পানিতে চুবিয়ে হত্যা করে। এই হত্যার নির্মমতা এ ভয়াবহতার দিকে আমরা দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, একটি শিশুর কানের একবিন্দু দুলই দু’টি শিশুর অকালে জীবাননাশের কারণ হল। যদি এক আনা সোনার এই দুলটি মেয়েটির কানে না থাকতো তবে সম্ভবত দুটি অমূল্য প্রাণের এমন অসহায় অবসান দেশবাসীর দেখতে হত না।
যে পরিচারিকাটি মেরিনা ও সুমি নামের শিশু দুটিকে চরম নির্মমতার সাথে দুটি এক আনা সোনার দুলের জন্য হত্যা করেছে তাঁর নাম হালিমা। হালিমা বিধবা, তারও সুমি ও মেরিনার মট চার পাঁচ বছরের দু’টি মেয়ে আছে। সোনার লোভ যে সর্বনাশ করেছে তা অবর্ণনীয়। যদি হালিমা সুমি ও মেরিনার কাছ থেকে সাবধানে দুল দুটি অপহরণ করতে পারতো তবে সৃষ্টি হত অন্য দৃশ্যের। বঞ্চিত এক বিধবার সন্তানের আনে হয়ত এই এক আনা সোনার দুল দুটি দুলতো। হালিমার মাতৃহৃদয় এতে পরিতৃপ্তি হতো। দৈব তাঁকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে অদৃশ শয়তানের হাতে সঁপে দিয়েছে। যার প্রভাব অর্থাৎ অবৈধ লোভে সে প্রতিওবেশির পরিচিত দু’টি বাচ্চাকে নাম বলে দেবে এই ভয়ে হত্যা করতে দ্বিধা করেনি। হায়রে সোনার দূল!
আমরা বিষয়টির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে আর যেতে চাই না। তবে সোনার প্রতি এ দেশের মানুষের একটা কুসংস্কারজনিত ব্যাধি নিয়ে দু’চার কথা বলতে চাই। সোনা খুব মূল্যবান ধাতু বলেই এটা বিপজ্জনক। এ ধাতুর অলংকার নিরাপদে ঘরে রাখা যায় না। গলায় পরে একা একা বিচরণ করা যায় না। অন্যকে ধার দিয়ে ব্যবহার করতে দিয়েও স্বস্তি নেই। এ এক নিত্য দুশ্চিন্তার ব্যাপার। এ ধরণের ধাতু বা অলংকারের প্রতি ইসলামের কোন সমর্থন নেই। সোনা স্তূপীকৃত করার বিরুদ্ধে ইসলামের কঠোর নিষেধবাণী উচ্চারিত হয়েছে। মোটকথা, সোনার ব্যাপক ব্যবহারের ব্যাপারে ইসলাম মানুষকে মূলত আমার বিবেচনায় নিরুৎসাহ করতে চায়। পুরুষ মানুষকে তো সোনার আংটি পর্যন্ত ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে।
আমাদের ধর্ম সোনার ব্যবহারকে উৎসাহ দেয়নি। এই এই দিকটির প্রতি নজর রেখে দেশ থেকে সোনার অলংকার ব্যবহারের ব্যাপক প্রচলনের বিরুদ্ধে নৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যদি অলংকার হিসেবে সোনার প্রচলন ও ব্যবহারকে নিরুৎসাহ করা সম্ভবপর হয়, তবে কত যে অঘটন, ডাকাতি, রাহাজানী ও হত্যাকাণ্ডের হাত থেকে মানুষ রেহাই পাবে এর ইয়ত্তা নেই।
লেখকঃ আল মাহমুদ। নারী নিগ্রহ ১৫/৫/৮৫
আরও পড়ুন>> সতী নারী কাকে বলে! সতী নারীর পরিচয়
আরও পড়ুন>> প্রেম করলে কি নারীর দেহ ভোগ করা যায়?
The post বয়ঃসন্ধির পাশবিকতা-আল মাহমুদ appeared first on Amar Bangla Post.