যেসমস্ত ক্ষেত্রে গর্ভজনিত কারণে মা বা শিশুর মৃত্যু বা রোগগ্রস্ততার সম্ভাবনা বেশি হতে পারে তাঁকে বেশি বিপদের গর্ভ বলে।
প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে অন্তঃসত্বা অবস্থায় এই সমস্যা দেখা যায়।
উন্নত বিশ্বে গর্ভজনিত কারণে মায়েদের মৃত্যু সংখ্যা কমতে কমতে একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বে মা ও শিশুর মৃত্যুহার এখনও আশ্চর্যরকমভাবে বেশি। মা ও শিশুমৃত্যুর কারণগুলি গর্ভাবস্থায় আগে থেকে থাকতে পারে অথবা গর্ভাবস্থার পরবর্তী পর্যায়ে, প্রসবের সময় বা তাঁর পরে সৃষ্টি হতে পারে। গর্ভ ও প্রসবজনিত জটিলতাগুলির বেশিরভাগই সৃষ্টি হয় বেশি বিপদের গর্ভ থেকে। এই জন্যই বেশি বিপদের গর্ভের সম্ভাবনাগুলি ম,আথায় রেখে গর্ভাবস্থায় পরিচর্যার গুরুত্ব অনেকখানি।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়যে, উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রতিবছর গর্ভজনিত কারণে প্রায় ৬ লক্ষাধিক মা মারা যান এবং ৯০ লক্ষাধিক রোগগ্রস্ততায় ভোগেন। অন্য দৃষ্টকোণ দিয়ে দেখলে দেখা যায় যে, উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১১০ জন মা গর্ভজনিত জটিলতায় ভোগেন এবং তাঁদের মধ্যে একজন মারা যান। ভারতবর্ষে প্রতি বছর প্রায় দেড় লক্ষ নারী মা হতে গিয়ে মারা যান। ভারতবর্ষে গর্ভজনিত কারণে মায়েদের মৃত্যু উন্নত বিশ্বের তুলনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ গুণ বেশি। উন্নয়নশীল বিশ্বের একজন নারী যখন গর্ভধারণ করেন, তখন শুধু এর জন্যই তাঁর মৃত্যুর বিপদ কোনো ক্ষেত্রে প্রায় ৫ থেকে ১০০ গুণ বেড়ে যায়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, মা হতে গিয়ে ভারতবর্ষে প্রতি ১ লক্ষ নারীর মধ্যে ৩৪০ জন মারা যান, সেখানে উন্নত বিশ্বে, যথা—ইংল্যান্ড, আমেরিকা, সুইডেন প্রভৃতি দেশে এর হার ১০-এর নীচে। উন্নয়নশীল বিশ্বে শিশুরমৃত্যুর হারও উন্নত বিশ্বের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি।
বেশি বিপদের গর্ভ বাছাই করা
গর্ভের কারণে মায়েদের মৃত্যু-সংখ্যা কমানোর জন্য এটি একটি সঠিক পদক্ষেপ। গর্ভবতী মায়েদের পরিচর্যার শুরুতেই বেশি বিপদের গর্ভগুলি চিহ্নতকরণ দরকার। গ্রামাঞ্চলের গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী বা উপযুক্ত ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মী বেশি বিপদের গর্ভগুলি চিহ্নতকরণ করতে পারেন। বেশি বিপদের গর্ভগুলি এই প্রকারঃ
- মায়েদের বয়সঃ ২০ বছরের নীচে বা ৩৫ বছরের বেশি বয়সে গর্ভধারণ সবসময়ই বেশি বিপদের গর্ভ। ২০ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে গর্ভধারণ বেশি নিরাপদ। গর্ভধারণের জন্য সবচেয়ে ভালো বয়স হল ২৩ থেকে ২৬ বছর।
- উচ্চতাঃ ৪ ফুট ১০ ইঞ্চির কম উচ্চতা হলে বেহসি বিপদের গর্ভ হিসাবে ধরা হয়।
- ওজনঃ মায়ের ওজন অতিরিক্ত হলে তা বেশি বিপদের গর্ভ।
- অনুর্বরতার পর গর্ভধারণঃ বেশিদিন ধরে অনুর্বরতার পর গর্ভধারণ হলে তা বেশি বিপদের গর্ভ।
- গর্ভপাতের ইতিহাসঃ যখন দুই বা ততোধিক গর্ভপাতের পর গর্ভধারণ হয়, তা বেশি বিপদের গর্ভ।
- পূর্ববর্তী গর্ভের ইতিহাসঃ প্রথম স্বাভাবিক ও প্রসব স্বাভাবিক হলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় গর্ভ এবং প্রসবের বিপদ সবচেয়ে কম থাকে। পঞ্চম বা তাঁর বেশি গর্ভের বিপদ অনেক বেশি।
- অপারেশনের পর গর্ভধারমঃ জরায়ু, সার্ভিক্স বা প্রস্রাবথলির অপারেশনের পর গর্ভধারণ বেশি বিপদের গর্ভ।
- পূর্ববর্তী গর্ভের ইতিহাস খারাপ থাকলেঃ পূর্বে মায়ের পেটে শিশু মারা গেলে, জন্মের অল্পদিনের মধ্যে শিশু মারা গেলে, ৩৭ সপ্তাহের আগে প্রসব, গর্ভের অনুপাতে কম ওজনের শিশুর জন্ম, শিশুর ওজন ২.৫ কেজির কম বা ৪ কেজির বেশি হলে বর্তমান গর্ভ বেশি বিপদের বলে ধরে নেওয়া হয়।
- গর্ভে শিশুর অস্বাভাবিক অবস্থিতি থাকলে তা বেশি বিপদের গর্ভ।
- গর্ভের কারণে রোগ, যথা—প্রি এক্লাম্পসিয়া, এক্লাম্পসিয়া, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় রক্তক্ষরণ বেশি বিপদের গর্ভের ইঙ্গিত দেয়।
- মায়ের হার্টের রোগ, ফুসফুসের রোগ, উচ্চরক্তচাপ, মধুমেহ রোগ, মৃগী ইত্যাদি থাকলে তা বেশি বিপদের গর্ভ।
- রক্তের গ্রুপঃমায়ের গ্রুপ নেগেটিভ ও স্বামীর গ্রুপ পজিটিভ থাকলে। এক্ষেত্রে গর্ভশয্যায় শিশুর মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে।
- পারিবারিক ইতিহাসঃ নীচু আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পরিবারের কারও দুই বা ততোধিক শিশু জন্মানোর ইতিহাস থাকলে তা বেশি বিপদের গর্ভ বলে পরিগণিত হবে।
বেশি বিপদের গর্ভের জন্য ব্যবস্থাপনা
- বেশি বিপদের গর্ভ চিহ্নিতকরণ ও অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়, প্রসবের সময় এবং পরে মা ও শিশুর উপযুক্ত যত্ন নেওয়া খুব জরুরী।
- প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের গর্ভবর্তী মায়েদের যত শীঘ্র সম্ভব পরীক্ষা করে বেশি বিপদের গর্ভগুলিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে মহকুমা, জেলা বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর বন্দোবস্ত করা একান্ত দরকার।
- যে-সমস্ত রোগীর পূর্বের গর্ভধারণ ফলপ্রসূ হয়নি, তাঁদের রোগ অনুসন্ধান পরবর্তী গর্ভধারণের আগেই করা উচিত। জরায়ুতে জন্মগত বা গঠনগত ক্রটি আছে কি না তা আল্ট্রাসাউন্ড বা এইচ.এস.জি. করলে বোঝা যায়।
- এছাড়া উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির রোগ, থাইরয়েডের ক্রটি ইত্যাদি জন্যও সম্পূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা করা হয়।
নিয়ম মাফিক পরীক্ষা
+রক্তপরীক্ষাঃ রক্তের গ্রুপ, হিমোগ্লোবিন, শর্করার পরিমাণ, যৌনরোগ আছে কি না তার জন্য ভি.ডি.আর.এল. পরীক্ষা করা হয়। রোগীর ইতিহাস শুনে কোনোরকম সন্দেহ হলে এডস-এর জন্য রক্তপরীক্ষা করা বিশেষ দরকার। কারণ একটি সমীক্ষায় অনুমান করা হচ্ছে যে, পশ্চিমবঙ্গে প্রতি হাজার প্রসূতির মধ্যে তিন-চার জন এডস (H.IV.) সংক্রামিত। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
+প্রস্রাব পরীক্ষাঃ প্রস্রাবের কোনো সংক্রমণ আছে কি না তা দেখার জন্য। এছাড়াও স্থানবিশেষে আল্ট্রাসোনোগ্রাফী, কোরিয়নিক ভিল্লাস-এর বায়োপসি, অ্যামনিওসিন্টেসিস ইত্যাদি পরীক্ষা জরুরী যখন শিশুর জিনগত ক্রটি বা বিকলাঙ্গ হতে পারে বলে ভাবা হয়।
তাছাড়া প্রসূতিকে খাদ্য, বিশ্রাম, ওষুধ, যৌন #সহবাস , ভ্রমণ ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক উপদেশ দেওয়া হয়।
চিকিৎসা
স্ত্রীরোগ ও শিশু-বিশেষজ্ঞের সঙ্গে অ্যানাস্থেটিক ডাক্তার অর্থাৎ রোগীকে অজ্ঞান করানোর চিকিৎসক রয়েছে, এমন চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রসব করানো দরকার। দরকার পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন প্রসবগার, ভালো অপারেশন থিয়েটার ও নবজাত শিশুর জন্য ইনকিউবেটর ও জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভালো ব্যবস্থা সম্পন্ন হাসপাতাল যেখানে প্রয়োজনে জীবনদায়ী ও জরুরী ওষুধপত্রও পাওয়া যাবে। কারণ বেশি বিপদের গর্ভের ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রসূতির সিজার করার প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনে শিশুর নিরাপদের কথা ভেবে বহু ক্ষেত্রে গর্ভের ৩৭-৩৮ সপ্তাহে প্রসব করানো হয়। প্রসবের সময় বেশি সতর্কতার সঙ্গে প্রসবের অগ্রগতি লক্ষ্য করা হয়।
আপনি পড়ছেন : গর্ভবতী মা ও সন্তান বই থেকে।
লেখকঃ ডাঃ অবিনাশ চন্দ্র রায়। ( স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ)
এই বই থেকে পূর্বে প্রকাশিত আর্টিকেল সমূহ…
22 ভ্রূণের লিঙ্গ (ছেলে না মেয়ে) নির্ধারণ
26 নকল গর্ভ
লেখাটি পড়ার জন্য আমার বাংলা পোস্ট.কম ব্লগ পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
আমাদের লেখিত ও প্রকাশিত আর্টিকেল, বই ও লাইফস্টাইল টিপস গুলো পড়ে আপনার কাছে ভালো লাগলে শেয়ার করে আপনার বন্ধুদেরকে জানান। আমাদের প্রকাশিত আর্টিকেল-বই ও টিপস সম্পর্কে আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।
The post বেশি বিপদের গর্ভ – পরীক্ষা ও চিকিৎসা appeared first on Amar Bangla Post.