ছেলেটাকে ঠিক গাঁজাখোরদের মতই লাগতো। না, কারা গাঁজা খায় এটা আমি জানি না। কিম্বা গাঁজা খেলে চেহারাটা আসলে কেমন হয় সেটাও আমার জানা নেই। কিন্তু পাতলা, রোগা, হ্যাংলা ধরণের কোন ছেলে দেখলেই আমার মনে হয় এ গাঁজাখোর। হয়ত হতে পারে এটা আমার মানসিক সমস্যা।
:
লালন নামের ছেলেটাকেও আমার তেমনই লাগতো। তার উপর ছেলেটা ফর্সাও নয়। অর্থাৎ, খারাপ লাগার ষোলকলা পূর্ণ হতে যা যা দরকার সবই এই ছেলেটার মধ্যে ছিল। এই অদ্ভুত ছেলেটাই আমাকে জীবনের প্রথম প্রেমপত্র দিয়েছিল।
(অদ্ভুত বলতে আমি বিশ্রী চেহারাটাকে বুঝাচ্ছি)
আমি সারা রাত ধরে চিঠিটা পড়লাম। বারবার পড়ি, আবার ভাঁজ করে বালিশের নিচে রেখে দিই।
আশ্চর্য! চিঠিটার সহজ-সরল ভাষা আর অকপট স্বীকারোক্তি আমার সারাটা রাতের ঘুমই কেড়ে নিল!
:
“অনামিকা,
জানি, আমি তোমার প্রেমের যোগ্য নই। তবু ভালবেসে ফেলেছি অনেক। কতটা ভালবেসেছি সে ঐ রাতের আকাশ জানে। ওরা জানে কত রাত আমি দু’চোখের উপর দিয়ে পার করে দিই শুধু তোমার কথা ভেবে। আমি গ্রামের ছেলে অনামিকা। তোমাদের মত অত স্মার্ট নই। হয়ত আমার মত ছেলেদের ভালবাসা যায় না, করুণা করা যায়। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি তোমার করুণাটুকুই মনে প্রাণে পেতে চাই। এটুকু দয়া আমায় করবে না?”
:
পরদিন সোজা নজরুল স্যারের হাতে চিঠিটা দিলাম। (নজরুল স্যার আমাদের কোচিং সেন্টারের পরিচালক যেখানে আমরা এস.এস.সির জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ওহ, বলতে ভুলে গেছি – লালন ছেলেটাও কোন একটা গ্রাম থেকে এসেছিল প্রস্তুতি কোচিং করতে। পারফর্মেন্স ভালই ছিল। ক্লাসে কখনোই খারাপ করতো না। বলা যায়, এটাই ছিল ওর একমাত্র গুণ)
নজরুল স্যার সবার সামনে ওকে দাঁড় করালেন। কড়া ভাষায় অপমান করলেন। মুহূর্তেই ছেলেটার চোখ টকটকে লাল হয়ে গেল। আমি সে চোখের দিকে তাকাতে পাচ্ছিলাম না। কি যে খারাপ লাগছিল আমার!
:
তারপর আরও ক্লাস করলাম এক সাথে। লালন আর কখনোই আমার সাথে কথা বলেনি। আমাকে দেখলেই এমন ভাব করতো যেন অনামিকা বলে কেউ ওর চোখে পড়েইনি কোনদিন। ব্যাপারটা আমায় খুব জ্বালা দিচ্ছিল।
বেশ কিছুদিন যেতেই সবাই অবাক হয়ে গেলাম আমরা। একদম সব্বাইকে টপকে গেল লালন। সব পরীক্ষাতেই ভাল করতে লাগলো। এরপর এল চূড়ান্ত মডেল টেস্ট। আমাদের হতাশ করে দিয়ে লালনই ফার্স্ট হল। কোনরকমে টপ টেনে জায়গা হল আমার।
:
সংবর্ধনার আগের রাতে অপটু হাতে লালনের জন্য চিঠি লিখলাম আমি।
“লালন,
জানি আমার উপর রেগে আছো। সেটাই স্বাভাবিক। আমি তোমাকে অপমান করলাম আর তুমি আমায় দেবী ভেবে পূজা করবে এটা ভাবা বোকামি। এটা আমি ভাবছিও না।
তবে আমি কিন্তু তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য স্যারকে বলে দিইনি।
তুমি আমার জন্য সারা রাত জাগতে এটা আমার ভাল লাগেনি। এস.এস.সির আগে অকারণে এক রাত জাগা মানে এক মাস পিছিয়ে যাওয়া। আমার জন্য তোমার খারাপ হবে এটা আবার কেমন কথা? তোমার খারাপ হলে তোমার নিজের জন্য হবে।
দেখো, তোমায় আমি বুঝিয়ে বললে তুমি হয়ত বুঝতে। কিন্তু তোমার মনে কিঞ্চিৎ আশা থাকতো। সেই আশা তোমার আরও ক্ষতি করতো।
তাই তোমাকে একটা ধাক্কা দেয়া দরকার ছিল যে ধাক্কায় তোমার লক্ষ্যপূরণ হবে। আমি সেটাই করেছি। তুমি গ্রামকে ছেড়ে, কাছের মানুষদের ছেড়ে এত দূরে যে আশায় এসেছো সেটা পূরণ হোক – এটাই চাই।
আর হ্যাঁ, তোমার মত ব্রিলিয়ান্ট একটা ছেলে অন্যের করুণা প্রার্থনা করবে এটা ঠিক না।
তোমাকে করুণা করার যোগ্যতা আমার নেই। তোমার ফোন নাম্বারটা দিয়ো। কোনদিন তোমার ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য হলে জানাবো।”
:
সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষ। লালনকে একটা মুঠোফোন গিফট করা হয়েছে। আমি ধীরে ধীরে লালনের খুব কাছে গেলাম। আস্তে করে বললাম,
“লালন, তোমার জন্য একটা চিঠি এনেছি।”
লালন চড়া গলায় বললো,
“ওটা তোমার কাছেই রেখে দাও। মানুষের মন পরিবর্তনশীল।”
:
আমার চোখে পানি এসে গেল। এই রকম পানি লালনের চোখেও এসেছিল একদিন। সত্যিই তো, সময় দ্রুত বদলায়। তার চেয়েও দ্রুত বদলায় মানুষের মন।
লেখিকাঃ অনামিকা খুশবু অবনী
The post মানুষের মন | অনামিকা খুশবু অবনী appeared first on Amar Bangla Post.