যারা মদীনা শরীফ যিয়ারত করতে যাবেন এবং তাঁদের যাওয়ার ইচ্ছে আছে তাঁরা জেনে নিন মদীনা শরীফের ফযীলত, মদীনা শরীফ যিয়ারত করার নিয়মাবলী ও মদীনা শরীফ যিয়ারতের দোয়া দরূদ সমূহ। আপনার জ্ঞানার্থে এই আর্টিকেলে মদীনা শরীফের যিয়ারতের প্রয়োজনীয় বিষয়াদি এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
মদীনা শরীফের ফযীলত ও যিয়ারতের আদবসমূহ
সংকলন
ডঃ সুলায়মান বিন সালেহ বিন আবদুল আযীয আল আযীয আল গুসুন।
অধ্যাপক, আল-ইমাম মুহাম্মদ বিন সউদ ইসলামিক ইউনিভার্সিটি
অনুবাদঃ কিং আব্দুল্লাহ (অনুবাদ ও আরবিকরণ ইনস্টিটিউট)
পরম করুণাময় দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
মদীনা শরীফ….এটি রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মদীনা শরীফ….এবং এটি হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের স্থান। তার অন্যান্য নামসমূহের মধ্যে হচ্ছেঃ ত্বাবাহ ও ত্বাইবাহ। মদীনা শরীফের অনেক ফযীলত রয়েছে, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ
০১. এ শহরে বসবাস করা কল্যাণজনকঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ মদীনা শরীফ তাঁদের (বসবাসের) জন্য উত্তম যদি তাঁরা (এস্থানের ফযিলত) জানতো। (বুখারী ও মুসলিম)
০২. মদীনা শরীফ মন্দ ও নিকৃষ্ট মানুষকে বের করে দেয়ঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা শরীফ সম্পর্কে বলেছেনঃ মদীনা শরীফ এমনভাবে মন্দ মানুষকে বের করে দেয় যেমনি কামারের হাপর খারাপ লোহার ময়লা দূর করে দেয়। (বুখারী ও মুসলিম)।
০৩. ঈমান মদীনা শরীফে ফিরে যাবেঃ মদীনা শরীফে ঈমান মিলিত এবং সমবেত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ নিশ্চয়ই ঈমান মদীনা শরীফে এমনভাবে ফিরে যাভে যেমনিভাবে সাপ তার গর্তে ফিরে যায়। (বুখারী ও মুসলিম) এজন্যই মদীনা শরীফের ফযীলত লাভের জন্যে প্রতিটি মুমিন প্রত্যাশা করে।
০৪. মহামারী ও দাজ্জাল থেকে মদীনা শরীফ সংরক্ষিতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ মদীনা শরীফের প্রবেশ পথসমূহে ফেরেশতাঁরা (পাহারারত) আছে, ফলে এখানে মহামারীও প্রবেশ করতে পারবেনা দাজ্জালও প্রবেশ করতে পারবেনা। (বুখারী ও মুসলিম)
০৫. মদীনা শরীফে বরকত রয়েছেঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ হে আল্লাহ আপনি মক্কায় যে বরকত দিয়েছেন মদীনা শরীফে তার দ্বিগুণ দান করুণ। (বুখারী ও মুসলিম)
০৬. মদীনা শরীফে কষ্টে ধৈর্যধারণ করার ফযীলত রয়েছেঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ এ শহরে কষ্ট এবং কঠিন সঙ্কটে যে ব্যক্তি ধৈর্যশীল হবে কেয়ামতের দিন আমি তার পক্ষে সাক্ষী কিংবা সুপারিশকারী হবো। (মুসলিম)
০৭. মদীনা শরীফ পবিত্র স্থানঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ মদীনা শরীফের আ’ইর এবং ছাউর (পাহাড়দ্বয়)-এর মধ্যবর্তী স্থানটুকু হারাম শরীফ (পবিত্র), যে ব্যক্তি এ স্থানটিতে কোন খারাপ কাজ ঘটাবে বা কোন খারাপ কাজ সৃষ্টিকারীকে আশ্রয় দিবে, ঐ ব্যক্তির উপর আল্লাহ, ফেরেশতাগণ এবং সকল মানুষের পক্ষ থেকে লা’নত। (মুসলিম) মদীনা শরীফ হারাম শরীফ (পবিত্র স্থান) হওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন হাদীস যে বিষয় সমূহ অন্তর্ভূক্ত করে তা নিম্নরূপঃ
এখানে শিকার করা নিষিদ্ধ, গাছ কাঁটা এবং যুদ্ধের অস্ত্র বহন করা নিষিদ্ধ, ঘৃণিত কোন ঘটনা ঘটানো এবং কোন অন্যায়কারীকে আশ্রয় দেয়া নিষিদ্ধ। অর্থাৎ, এখানে মন্দ ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাজসমূহ নিষিদ্ধকরণ হয়েছে, এবং এর বাসিন্দাদের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
০৮. যারা মদীনাবাসীর অনিষ্ট চায় তাঁদের জন্য সতর্কবার্তাঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ কেউ যদি মদীনাবাসীর ক্ষতি করতে চায় আল্লাহ তাঁকে জাহান্নামে সিসা বা লবণ-এর ন্যায় গলিয়ে ফেলবেন। (মুসলিম)
০৯. মসজিদে-নববীতে নামাযের ফযীলতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমার এ মসজিদে এক রাকাত নামায পড়া, আল মসজিদুল হারাম ব্যতীত অন্যান্য মসজিদে এক হাজার রাকাত নামায পড়া থেকেও উত্তম। (বুখারী ও মুসলিম)
১০. রওযা শরীফের ফযীলতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমার ঘর এবং আমার মিম্বরের মাঝে যে স্থানটি রয়েছে তা জান্নাতের একটি টুকরো। (বুখারী ও মুসলিম)
মদীনা শরীফে শরিয়ত সম্মত যিয়ারতের স্থানসমূহঃ মদীনা শরীফে কিছু স্থান আছে যা যিয়ারত করা শরীয়ত সম্মত এবং নিয়ত করে ওখানে যাওয়া যাবে, এগুলো হলোঃ
০১. মসজিদে নববীঃ এটা হলো মদীনা শরীফে সফরের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তিনটি মসজিদ ছাড়া সাওয়াবের উদ্দেশ্যে অন্য কোথাও সফর করা যাবে নাঃ আল মসজিদুল হারাম, আমার এই মসজিদ এবং আল মসজিদুল আকসা। (বুখারী ও মুসলিম)
মসজিদে নববী যিয়ারতের আদব সমূহঃ
যিয়ারতকারী যখন মসজিদে পৌঁছবেন তখন তার ডান পা দিয়ে প্রবেশ করবেন এবং নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সালাম দিবেন ও দোয়া পাঠ করবেন।
দোয়া এই : আল্লাহম্মাফতাহ লি আবওয়াবা রাহমাতিকা। অর্থঃ হে আল্লাহ আপনি আমার জন্য আপনার রহমতের দরজাগুলো খুলে দিন।
অতঃপর দু’রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামায আদায় করবেন। অতঃপর নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর সালাম পেশ করতে যাবেন। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কবরকে সামনে রেখে এবং কেবলাকে পিছনে রেখে পাঠ করবেনঃ
“আসসালামু আ’লাইকা আইয়্যুহান্নাবিয়্যূ ওয়া রাহমাতুল্লাহী ওয়া বারাকাতুহু, আশহাদু আন্নাকা বাল্লাগতার রিসালাতা ওয়া নাসাহতাল উম্মাতা ওয়া জা’হাদতা ফিল্লাহি হাক্কা জিহাদিহি।
অর্থঃ হে নবী আপনার উপর শান্তি, রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি রিসালাত পৌঁছিয়েছেন ও উম্মতকে উপদেশ দিয়েছেন এবং আল্লাহর পথে সঠিকভাবে জিহাদ করেছেন।
অতঃপর ডান দিকে এক পয়া এগিয়ে পাঠ করবেনঃ আসসালামু আ’লাইকা ইয়া আবা বকর আস ছিদ্দিক, ইয়া খালিফা রাসূলিল্লাহ, রাদ্বিয়াল্লাহু আ’নকা ওয়া জাযাকা আ’না উম্মাতে মুহাম্মাদিন খাইরান।
অর্থঃ হে রাসূলের খলিফা আবু বকর সিদ্দিক আপনার উপর শান্তি বর্ষিক হোক, আল্লাহ আপনাকে উপর সন্তুষ্ট হউন, এবং আপনাকে উম্মাতে মুহাম্মাদীর পক্ষ থেকে সবচেয়ে উত্তম প্রতিদান দান করুণ।।
অতঃপর তার ডান দিকে এগিয়ে পাঠ করবেনঃ আসসালামু আ’লাইকা ইয়া ওমর, রাদ্বিয়াল্লাহ আ’নকা ওয়া জাযাকা আ’ন উম্মাতে মুহাম্মাদিন খাইরান।
অর্থঃ হে ওমর, আল্লাহ আপনার উপর সন্তুষ্ট হউন এবং আপনাকে উম্মাতে মুহাম্মাদীন পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশী উত্তম প্রতিদান দান করুণ।
সালাম বিনিময়ের সময় তার (যিয়ারতকারী) উচিত হবে আদব রক্ষা করা এবং দীর্ঘ সময় ওখানে দাঁড়িয়ে না থাকা।
যিয়ারতকারির উচিত হবে তার সময়ের বেশীর ভাগ মসজিদে নববীতে অবস্থানের সুযোগ লাভ করা এবং অধিক পরিমাণ দোয়া, ইস্তেগফার, যিকির, কোরআন তেলাওয়াত ও শিক্ষামূলক মজলিশে বসা সহ অন্যান্য নেক কাজ করা।
০২. মসজিদে ক্বুবাঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পায়ে হেটে বা কখনো সওয়ারি হয়ে প্রতি শনিবার মসজিদে ক্বুবাতে যেতেন, তিনি বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ঘর থেকে বের হয়ে এই মসজিদ পর্যন্ত আসবে-অর্থাৎ মসজিদে ক্ক্বুবাতে-এবং সেখানে নামায পড়বে সে একটি ওমরার সওয়াব পাবে। (ইমাম আহমদ প্রমূখ)
০৩. বাক্বী’র কবরস্থান এবং ওহুদের শহীদগণের যিয়ারতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাক্বী’তে যেতেন, সেখানে ক্ববরস্থ তার সাহাবাগণের সালাম দিতেন এবং তাঁদের জন্য দোয়া করতেন। (মুসলিম)
বুখারি ও মুসলিম কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে আছে যে, একদিন তিনি ওহুদের শহীদদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান, অতঃপর ওখানে তাঁদের জন্য দোয়া করেন। মদীনা শরীফে শুধু উল্লেখিত স্থানের যিয়ারত করা শরীয়ত সম্মত, এছাড়া যা কিছু আছে সেগুলো বিশেষভাবে যিয়ারত করার ব্যাপারে শরীয়তে কোনো প্রমাণ নেই। বরং তা হচ্ছে মানুষের প্রবর্তন করা বিদআ’ত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনে নেই এমন নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে তা বর্জনীয়। (বুখারী ও মুসলিম)
অন্য বর্ণনায় রয়েছেঃ যে ব্যক্তি আমাদের ধর্মে নেই এমন কোন কাজ করবে তা বর্জনীয়। (মুসলিম)
সুতরাং, যিয়ারতকারীর জন্য উচিত হবে তার সময়কে এমন সব কাজে লাহানো যা ইসলামী শরীয়ত পছন্দ করে। আর এমন কোন স্থানে গিয়ে সময় নষ্ট না করা যেখানে যিয়ারত করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উৎসাহ প্রদান করেননি এবং সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আ’নহুম এ সব স্থানে (যিয়ারতে) যাননি।
যিয়ারতকারীর জন্য কিছু জ্ঞাতব্য বিষয়
০১. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উম্মতকে আদেশ করেছেন যেকোন স্থানে থেকে তার উপর সালাত ও সালাম পাঠ করতে। আর একথাও বলে দিয়েছেন যে এগুলো তার কাছে পৌঁছানো হয়। সুতরাং তার উপর সালাত ও সালাম পেশ করার বিষয়টি তার কবরের পাশে উপস্থিতির সংশ্লিষ্ট নয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা আমার কবরকে উৎসবের স্থানে পরিণত করো না, আর তোমাদের ঘর গুলোকে কবরে পরিণত করো না, তোমরা যেখানেই থাকো আমার উপর দুরুদ পড়, কেননা, নিশ্চয় তোমাদের দুরুদ আমার কাছে পৌঁছে। (ইমাম আহমদ প্রমুখ)
কাজেই তার উপর সালাত ও সালাম পাঠ করতে তার কবরের নিকট সফর করার প্রয়োজন নেই। আর এ বৈধতাও নেই যে, কেউ কারো মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট সালাম পৌঁছে দেয়ার জন্য কাউকে দায়িত্ব অর্পণ করা, কেননা ফেরেশতারা যেকোন স্থান থেকে তার কাছে সালাম পৌঁছে দেয়। তার কবরের নিকট যাওয়ার ফযীলত প্রসঙ্গে উল্লিখিত হাদীসসমূহ সহীহ নয়।
অনুরূপভাবে যিয়ারতকারীর জন্য এটাও শরীয়ত সম্মত নয় যে, যতবারই মসজিদে নববীতে আসবেন ততবারই তার কবর মুকাররামে নিকট যাবেন। কেননা, সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম এমনটি করেননি। আর মসজিদে নববীতে প্রবেশকারী প্রবেশের সময় যে সালাম পেশ করে এবং নামাযে তাশাহুদে যখন সালাম পড়ে তার কবরের নিকট যাওয়ার প্রয়োজন ছাড়াই ঐ সালাম তার কাছে পৌঁছে যায়।
০২. যিয়ারতকারীর জন্য উচিত হবে মসজিদে নববীতে অজ্ঞ ও বিদআ’তিদের কার্যাবলী থেকে সতর্ক থাকা, যেমনঃ মিহরার, মিম্বর, খুঁটিসমূহ, দেয়ালসমূহ, দরজা-জানালাসমূহ মোছা বা চুমো খাওয়া। এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে হুজরায় দাফন করা হয়েছে তার তাওয়াফ করার চেষ্টা করা, বা হুজরার নিকট দোয়া করা। এর চেয়েও অধিকতর খারাপ যদি কোন বিদ’আতি ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মর্যাদা, অধিকারের উসিলায় দোয়া, এ ধরণের কিছু আমল করে যার ব্যাপারে পবিত্র শরীয়তে কোন ভিত্তি নেই। আরো কুৎসিত ও ন্যাক্কারজনক কাজ হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সুপারিশ এবং এমন কিছু চাওয়া যা আল্লাহ ছাড়া কেউ দিতে পারেন না। যেমনঃ গুনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা, বিপদ থেকে মুক্তি, জান্নাতে প্রবেশ, জাহান্নাম থেকে মুক্তি, রোগ মুক্তি কামনা, শত্রুর উপর বিজয়, রিযিক ও সন্তান কামনা সহ অন্যান্য, যা বড় শিরিক হিসেবে গণ্য, যে মহাপাপ আল্লাহ ক্ষমা করেন না। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করেন না, যে লোক তার সাথে শরীক করে। (সুরা আন নিসাঃ ৪৮) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেছেনঃ তুমি যদি (আল্লাহর) শরীক স্থির করে থাকো তাহলে তোমার কর্ম নিস্ফল হবে। (সুরা যুমারঃ ৬৫)
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ থেকে সতর্ক করেছেন এবং যে ব্যক্তি এ কাজ করবে তাঁকে লা’নত করে বলেছেনঃ ইয়াহুদী ও নাসারাদের উপর আল্লাহ লা’নত, এজন্য যে, তাঁরা তাঁদের নবীদের কবর সমূহকে সেজদার স্থান হিসেবে গ্রহণ করেছে। (বুখারী ও মুসলিম)
অথচ আবশ্যকীয় হচ্ছে একনিষ্ঠাতার সাথে আল্লাহর কাছে দোয়া করা। আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
“তোমরা তাঁকে খাঁটি আনুগত্যশীল হয়ে ডাক। (সুরা আল আরাফঃ ২৯)”
এবং আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
“মসজিদ সমূহ আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করার জন্য। অতএব তোমরা আল্লাহ তা’আলার সাথে কাউকে ডেকো না। (সুরা আল জ্বীনঃ ১৮)”
০৩. সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমদের কবর যিয়ারতকারীর জন্যে উচিত হবে, যখন বাক্বী’ কবরস্থানে এবং ওহুদের কবরস্থানে যাবেন, তখন কবর যিয়ারতের হেকমত যে আখিরাতের স্মরণ, এটি মনে করা এবং কবরবাসীদের জন্য দোয়া করা।
অহেতুক অস্থিরতা ও রাগারাগি প্রকাশ করা থেকে সতর্ক থাকতে হবে। এমন সকল থেকে সতর্ক থাকতে হবে। এমন সকল কাজ থেকে সতর্ক থাকতে হবে যেসব কাজে শিরক রয়েছে অথবা শিরকের কারণ হবে।
যেমনঃ কবরের পার্শ্বে নামায পড়া, দোয়া এবং কিরাআতে মনযোগ দেয়া। অনুরূপ ভাবে সেখানে মোমবাতি জ্বালানো ও কোন অছিয়ত, উসিলা বা দোয়া সংবলিত চিরকুট বা অন্যান্য প্রয়োজন নিয়ে যাওয়া হারাম।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ সতর্ক হও কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীরা তাঁদের নবী ও সৎ ব্যক্তিদের কবর সমূহকে সেজদার স্থান বানাতো। সুতরাং, তোমরা কবর সমূহকে সেজদার স্থান বানাবে না আর আমি তোমাদের ঐ ব্যাপারে নিষেধ করছি। (মুসলিম)
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালবাসা
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তা’আলা গোটা মানব জাতির জন্য পাঠিয়েছেন এবং তার মাধ্যমে নবুওয়্যাত ও রিসালাত পরিপূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
“বল, হে মানবজাতি! তোমাদের সবার প্রতি আমি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। (সুরা আরাফঃ ১৫৮)”
আল্লাহ তা’আলা তাঁকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
“আমি তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি। (সূরা আল আম্বিয়াঃ ১০৭)।” আর আল্লাহ তা’আলা তাঁকে পথপ্রদর্শক, সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী হিসেবে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
“হে নবী! আমি তোমাকে সাক্ষী, সুসংবাদ দাতা, সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তার দিকে আহবায়করূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপ রূপে। (সূরা আল আহযাবঃ ৪৫-৪৬)”।
অতঃপর তিনি রিসালাতটি সর্বোত্তমভাবে সম্পন্ন করেছেন ও উম্মতকে নসিহত করেছেন এবং হুজ্জাত প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালবাসা ঈমানের সবচেয়ে বড় আবশ্যকীয়তার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। তাঁর ভালবাসা ঈমান ও দ্বীনের আমল সমূহের প্রত্যেকটি আমলের মূল। সুতরাং সমস্ত মাখলুকের ভালবাসার আগে তাঁর ভালবাসা অগ্রাধিকার পাবে, যেমনটি আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
“বল, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান যাকে তোম্মরা পছন্দ কর, আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত, আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না। (সূরা তাওবাঃ২৪)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে কেউ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না সে তাঁর পিতা, সন্তান ও সমস্ত মানুষ থেকে আমাকে অধিক ভালবাসবে। (বুখারী ও মুসলিম) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সত্যিকার অর্থে ভালবাসার প্রমাণ হলো নিম্নরূপঃ
০১. তাঁকে সম্মান ও মর্যাদা করা।
০২. তাঁর আনুগত্য করা ও তাঁর হেদায়েতের পথ অনুসরণ করা এবং সেই সাথে তাঁর সুন্নাত মেনে চলা।
০৩. তাঁর হাদীস সমূহ বিশ্বাস করা।
০৪. তাঁকে সাহায্য করা, তাঁর সুন্নাত আকড়ে ধরার প্রতি দাওয়াত দেয়া, এর সম্মান ও মর্যাদা করা এবং তা প্রতিরক্ষা করা।
০৫. দীনের মধ্যে বিদআ’ত না করা।
০৬. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর অধিক পরিমাণ দুরুদ পাঠ করা।
০৭. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করা।
সাহাবাতে কেরামের ফযীলত ও তাঁদের অধিকার সমূহ
উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ও উত্তম মানুষ হলেন সাহাবায়ে কেরাম। আল্লাহ তা’আলা তাঁদেরকে নির্বাচিত করেছেন তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সান্নিধ্যের জন্যে। তাঁরা তাঁর উপর ঈমান এনেছেন এবং তাঁকে সাহায্য করেছেন। তাঁরা আল্লাহর রাস্তায় যত বাঁধা, প্রতিবন্ধকতা, জটিলতা এবং কষ্টের সম্মুখীন হয়েছেন ধৈর্য ধারণ করেছেন। ফলে, আল্লাহ তা’আলা তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তাঁদের জন্যে জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
“আর যারা সর্ব প্রথম হিজরতকারী ও আনছারদের মাঝে পুরাতন, এবং যারা ইহসানের সাথে তাঁদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে, আর তাঁদের জন্যে প্রস্তুত করেছেন বাগান সমূহ যার তলদেশ দিয়ে নদী সমূহ প্রবাহিত। সেখানে আতার চিরকাল থাকবে, আর এটাই মহা সফলতা। (সূরা তাওবাঃ ১০০)”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমার যুগের মানুষ হল সর্বোত্তম মানুষ, অতঃপর তাঁদের পরবর্তী যুগে যারা আসবে, অতঃপর তাঁদের পরবর্তী যুগে যারা আসবে। (বুখারী ও মুসলিম)
সাহাবায়ের কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম এর কিছু অধিকার আছে যা প্রত্যেক মুসলমানের উপর অবশ্য পালনীয়, এ গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ
০১. তাঁদেরকে ভালবাসা এবং তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা।
০২. তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা ব্যাপারে বিশ্বাস রাখা।
০৩. তাঁদের ন্যায়পরায়ণতার ব্যাপারে বিশ্বাস রাখা।
০৪. তাঁদের সম্পর্কে অন্তরে ভাল ধারণা রাখা এবং তাঁদের মাঝে যে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে সে ব্যাপারে চুপ থাকা।
০৫. তাঁদেরকে গালি না দেওয়া, তাঁদের মর্যাদাকে অপমান বা ছোট না করা।
কাজেই, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবায়ে কেরাম হলেন সবচেয়ে উত্তম মানুষ, দীনের বাহক। সুতরাং তাঁদের গালি দেওয়া হচ্ছে তাঁদের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি ও সত্যায়নের অস্বীকার ও বিরুদ্ধাচারণ করা। আর এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেয়া হয় এবং তাঁদের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওসিয়তের বিরুদ্ধাচারণ করা হয়। এমনকি গোটা দীনের ব্যাপারে এমন সন্ধিহান দেখা দেয় যে এ দীন তাহলে তাঁদের মাধ্যম ছাড়াই আমাদের নিকট পৌঁছেছে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা আমার সাহাবাদের গালি দিবে না, তোমাদের কেউ যদি ওহুদ পাহাড় পরমাণ স্বর্ণ দান করে তাহলে তাঁদের এক মুঠো পরিমান বা তাঁর অর্ধেকও পৌঁছবে না। (বুখারী ও মুসলিম)
০৬. তাঁদের ব্যাপারে অতিরঞ্জিত না করা, জেনে রাখুন, মধ্যমপন্থা অবলম্বন হচ্ছে অতিরঞ্জিত এবং অহমিকা থেকে পরিত্রাণের উপায়। সুতরাং, তাঁদের মর্যাদা উঁচু করে প্রভুত্ব ও নবুয়তের মত স্থানের মর্যাদা দেয়া যাবেনা। সেই সাথে তাঁদেরকে অপমান ও গালির মাধ্যমে মর্যাদাও ক্ষুণ্ন করা যাবে না।
০৭. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবারের অধিকার সংরক্ষণঃ তাঁর পরিভূক্ত হলেন বনু হাসেম, বনু আব্দুল মুত্তালেব এবং তাঁর বিবিগণ উম্মাহাতুল মুমিনিন। তাঁর পরিবারের অধিকার সংরক্ষণ সম্পর্কে তিনি বলেছেনঃ আল্লাহর জন্যে আমি তোমাদেরকে আমার পরিবার-পরিজন ব্যাপারে উপদেশ দিচ্ছি। (মুসলিম)
সুতরাং, সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে থেকে যারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবার পরিজনদের অন্তর্ভূক্ত তাঁদের তিনটি হকঃ ঈমান, ছোহবত ও আত্মীয়তার সম্পর্ক। আর সাহাবায়ে কিরাম ব্যতীত যারা শুধু পরিবার পরিজনদের অন্তর্ভূক্ত তাঁদের দু’টি হকঃ ঈমান ও আত্মীয়তার সম্পর্ক।
এই আর্টিকেলটি অন্যদেরকে পড়াতে আপনার ব্যবহৃত সামাজিক মিডিয়ায় শেয়ার করুণ।
The post মদীনা শরীফের ফযীলত ও যিয়ারতের আদবসমূহ appeared first on Amar Bangla Post.