শিশুর তাৎক্ষণিক যত্ন কীভাবে নেওয়া হয়?
- প্রসবের পর একটি ট্রেতে জীবাণুমুক্ত তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে শিশুকে রাখা হয়। শিশুর মাথার দিক নীচু ও পায়ের দিক ৬ ইঞ্চি পরিমাপ উঁচুতে রাখা হয়, যাতে শিশুর নাক, মুখ ও শ্বাসতন্ত্র থেকে লাইকার আপনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
- শিশুর নাক, মুখ জীবাণুমুক্ত মিউকাস সাকার বা রবার বালব সিরিঞ্জ দিয়ে শুষে পরিষ্কার করা হয়।
- নাড়ি বাঁধাঃ জন্মের দু-তিন মিনিট বাদে নাড়ি সুতো দিয়ে বাঁধতে হবে। যদি RH নেগেটিভ মা হয় অথবা শিশুর সময়ের আগেই জন্ম হয়, তাহলে প্রসবের সঙ্গে সঙ্গে নাড়ি বাঁধতে হবে। দু’-তিন মিনিট দেরি করে নাড়ি বাঁধলে মায়ের শরীর থেকে প্রায় ১০০ মিলি-লিটার রক্ত নাড়ি দিয়ে শিশুর শরীরে প্রবেশ করে।
- জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শিশুকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে কোনো জন্মগত ক্রটি আছে কি না।
শিশুকে গোসল করানো কতটা জরুরি?
নিয়মমাফিক গোসল করানো দরকার নেই, বিশেষ করে হাসপাতালে প্রসব হলে। এর পরিবর্তে ভেজা জীবাণুমুক্ত নরম তোয়ালে দিয়ে শিশুর শরীর পরিষ্কার করতে হবে যাতে রক্ত, মেকোনিয়াম, ভার্নিক্স ইত্যাদি পরিষ্কার হয়ে যায়। গোসল করানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যে, পানি যেন শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় থাকে। সাবান দিয়ে গোসলের পর নরম তোয়ালে দিয়ে শিশুর শরীর হালকা করে মুছে দিতে হবে। শিশুর শরীর বেশি ঘষাঘষি করলে শিশুর নরম চামড়ায় আঘাতজনিত প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, যাকে সচরাচর ‘মাসি-পিসি (Aunty’s disease) বলে। হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার পর শিশুকে রোজ গোসল করাতে হবে।
- নাড়ির যত্নঃ পরিষ্কার-পরিছন্ন পরিবেশে নাড়ি খোলা রাখাই ভালো। ট্রিপল-ডাই লাগিয়ে অথবা রেক্টিফায়েড স্পিরিট ও মারকিউরোক্রোম লাগিয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।
- পোশাক-পরিচ্ছদঃ আবহাওয়া অনুযায়ী পোশাক দিতে হবে। হাত-পা ছোড়ার জন্য পোশাক নির্বাচন করতে হবে। ন্যাপকিন সময়ে সময়ে পালটাতে হবে।
- চোখের যত্নঃ চোখের সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য সোফরামাইসিন চোখের ড্রপ দু’চোখে দেওয়া যেতে পারে।
নবজাত শিশুর ছোটখাটো সমস্যা
- বমি করাঃ জন্মের পর-প্রথম দিনে বহু শিশু বমি করতে পারে। শিশুর পাকস্থলিতে লাইকর (Liquor) থাকার জন্য এটা হয়। প্রসবের সময় বা তার আগে শিশু বেশি পরিমাণ লাইকর খেতে পারে। প্লাস্টিক বা রবার টিউব দিয়ে শিশুর পাকস্থলি থেকে লাইকর বের করে পাকস্থলি পরিষ্কার (Stomach wash) করা হয়।
- বেশি কান্নাঃ শিশু খিদে পেলে অথবা কোনোরকম অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলে কাঁদে। প্রস্রাব বা পায়খানা করে ন্যাপকিন ভিজে গেলেও শিশু কাঁদে। এছাড়াও পেটে যন্ত্রণা (Colic pain) হলে শিশু কান্নাকাটি করে। এর জন্য শিশুকে Colimex drop পাঁচ ফোঁটা করে দেওয়া যেতে পারে।
- নাক বন্ধ থাকাঃ এর জন্য Nasivion mini drop অথবা Otrivin pediatric nasal drop এক ফোঁটা করে দিনে তিনবার দিতে হবে।
- চামড়ার সমস্যাঃ এর জন্য শিশুর গোসলের পর Johnson baby Powder শরীরে মাখিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
- ন্যাপকিন র্যাশঃ ন্যাপকিন ভিজে গেলে সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাতে হবে। ন্যাপকিন জীবাণুমুক্ত করার জন্য অ্যান্টিসেপটিক সলিউশনে ভিজিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
- কোষ্ঠকাঠিন্যঃ কৃত্রিম দুধ খাওয়ানোর শিশুদের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়। এর জন্য জোলাপ (Laxative) না ব্যবহার করাই ভালো। খাদ্যের ক্রটি সংশোধন এবং পানির পরিমাণ বাড়ালেই সমস্যা দূর হয়ে যায়, অন্যথায় Milk of magnesia আধ চামচ মুখ দিয়ে খাওয়াতে হবে।
শিশুর ভোজ/খাবার
জন্মের প্রথম ছ’মাস শিশুর বিকাশ ও বৃদ্ধির গতি তার পরিবর্তী জীবনের সময় থেকে অনেক বেশি ও দ্রুত হয়। ছ’মাসে তার ওজন দ্বিগুণ হয় এবং এক বছরে তিন গুণেরও বেশি হয়। এই কথা মনে রেখে শিশুর আহার উপযুক্তভাবে করতে হবে। এর পরিমাণ ও গুণগত মানও সঠিক রাখা দরকার।
শিশুর আহার দু’ধরনেরঃ ১. স্তনপান। ২. কৃত্রিম আহার।
- স্তনপানঃ মাতৃদুগ্ধ শিশুর সর্বোকৃষ্ট আহার। শিশুর সঠিক বিকাশ ও বৃদ্ধির জন্য যা যা দরকার, প্রকৃতির দান মায়ের দুধে তার সবই সঠিক মাত্রায় আছে।
বুকের দুধের সুবিধাগুলি কী কী
- ভারতবর্ষে মতো উন্নয়নশীল দেশে এটা উপকারী ও অর্থসাশ্রয়কারী।
- সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর।
- সহজলভ্য ও সঠিক তাপমাত্রায় পাওয়া যায়।
- জীবাণুমুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং মায়ের স্তন থেকে সরাসরি শিশুর পেটে পৌঁছয়। ফলে সংক্রমণের সম্ভাবনা কম। শিশুর পেটের রোগ (গ্যাস্ট্রোএনটারাইটিস) হওয়ার সম্ভাবনাও কম।
- শিশুর রোগ প্রতিরোধ করে। যেমন-রিকেট, স্কার্ভি, গ্যাস্ট্রোএনটারইটিস ইত্যাদি। মায়ের দুধের সন্মগে অ্যান্টিবডি শিশুর শরীরে প্রবেশ করে, যা শিশুর রোগ-প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- মা ও শিশুর মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলে।
- বুকের দুধ খাওয়ালে পক্ষান্তরে মায়ের প্রাকৃতিক উপায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ হয়। উন্নয়নশীল বিশ্বে এর গুরুত্ব অনেকখানি।
- পরিশেষে বুকের দুধ শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য হতে দেয় না, এতে অ্যালার্জি হয় না, প্রসবের পর জরায়ু সঙ্কুচিত হতে সাহায্য করে।
প্রসবের কতক্ষণ বাদে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে?
স্বাভাবিক প্রসবের পর সুস্থ শিশুকে একঘন্টা বাদেই মায়ের স্তন দিতে হবে। সিজার করে হলে চার ঘণ্টা বাদে দিতে হবে।
দিনে কতবার শিশুকে দুধ খাওয়াতে হবে?
সময় হিসাবে দিতে হলে তিন ঘন্টা বাদে বাদে স্তন পান করাতে হবে। অন্যথায় শিশুর যখন খিদে পাবে, তখনই খাওয়াতে হবে।
কতক্ষণ খাওয়াতে হবে?
প্রথমদিকে পাঁচ মিনিট করে প্রতিটি স্তনে খাওয়াতে হবে। পরবর্তীকালে দশ মিনিট করে।
রাতে শিশুকে খাওয়ানো উচিত কি না
শিশুর খিদে পেলে রাতেও খাওয়াতে হবে। শিশুর কাছে দিনও রাত্রির কোনো পার্থক্য নেই।
হাওয়া বের করা (Burping)
প্রতিটি স্তন পান করার পর শিশুকে ঘাড়ে শুইয়ে শিশুর পিঠে আস্তে আস্তে চাপড়াতে হবে। এর ফলে শিশুর মুখ দিয়ে অনেক হাওয়া বেরিয়ে আসে, যা শিশু স্তন খাওয়ার সময় পাকস্থলিতে জমা হয়।
শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় কী কী সমস্যা হতে পারে?
- কম আহার (Under feeding) : শিশু কান্নাকাটি করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়, শিশুর সথিক ওজন বৃদ্ধি হয় না। এর জন্য কৃত্রিম দুধ খাওয়াতে হবে।
- বেশি আহারঃ এক্ষেত্রে খাওয়ানোর পরপরই শিশু বমি করে, বারেবারে অজীর্ণ পাতলা পায়খানা করে। মলদ্বারের পাশের জায়গা ছড়ে যেতে পারে। এর জন্য শিশুকে অল্প সময় স্তন দান করতে হবে। দুধ খাওয়ানোর পূর্বে জীবাণুমুক্ত পানি খাওয়ালেও উপকার পাওয়া যায়।
- স্তন ফুলে ওঠা (Enjorged breast) : প্রসবের পর তৃতীয় বা চতুর্থ দিনে এটা হতে পারে। এর জন্য ঠান্ডা বা গরম সেঁক, স্তন মালিশ করে দুধ বের করে দিতে হবে, আঁটোসাটো বক্ষ-আবরণী পরতে হবে। কখনও ব্রেস্ট-পাম্প দিয়ে দুধ নিঙ্কাশিত করে শিশুকে খাওয়াতে হবে। অল্প দিন স্তনদান করা বন্ধ করে ওইভাবে নিঙ্কাশিত দুধ খাওয়ালে উপকার মেলে। তাতেও মায়ের আরাম না হলে ওষুধ প্রয়োগ করে বুকের দুধ কিছুটা কমাতে হবে।
- বসে-যাওয়া স্তনবৃন্ত (Retracted nipple) : Nipple-shield ব্যবহার করে শিশুকে স্তনপান করাতে হবে। এছাড়া আর উপায় নেই।
- ছেড়ে-যাওয়া স্তনবৃন্ত (Cracked nipple) : Massic breast cream অথবা Betadine মলম ব্যবহার করলে উপকার মেলে। শিশুকে স্তনপান করানোর সময় স্তনবৃন্ত পরিষ্কার করে নিতে হবে। অন্যথায় নিঙ্কাশিত দুধ শিশুকে পান করাতে হবে।
- স্তন-সংক্রমণ (Breast abscess) : এক্ষেত্রে স্তনদান সামুয়িক বন্ধ করে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ, গরম সেঁক এবং পুঁজ অপারেশন করে বের করে দিতে হবে।
স্তনপান করানো কালীন নিরাপদ-অনিরাপদ ওষুধ
- নিরাপদ ওষুধঃ স্তনদান করানো কালীন মাকে যে ওষুধগুলো খাওয়ানো যেতে পারে, তা হল—পেনিসিলিন, এরিথ্রোমাইসিন, সেফালোসপরিন, মেট্রোনিডাজোল, অ্যান্টাসিড, ভিটামিন ওষুধ, লৌহ, প্যারাসিটামল, অ্যাসপিরিন, ক্লোরোকুনইন ইত্যাদি।
- অনিরাপদ ওষুধঃ টেট্রাসাইক্লিন, ক্লোরামফেনিকল, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, স্টেরয়েড, অ্যালকোহল ইত্যাদি।
কোন কোন ক্ষেত্রে মা তার সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন না?
- মায়ের জতিলতাপূর্ণ হার্টের রোগ, কিডনির রোগ থাকলে।
- ফুসফুসের টিবি, যা কি না শিশুকে সংক্রামিত করতে পারে।
- স্তনের সংক্রমণ।
- প্রসবের পর মায়ের মানসিক রোগ (Puerperal Psychosis)।
- মা মৃগী রোগ বা ক্যানসারের ওষুধ খেলে।
- প্রসবের সময় মায়ের জনডিস থাকলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্তানকে স্তন দিতে পারবেন না।
শিশুর কতকগুলি রোগ থাকলে স্তন দেওয়া উচিৎ নয়।
যেমনঃ অতিরিক্ত অসুস্থ শিশু, অতিমাত্রায় অবিকশিত শিশু, শিশুর জন্মগত ক্রটি—ক্লেফটপ্যালেট, এসেফেজিয়াল এট্রেসিয়া, স্নায়ুর রোগ ও জন্মগত কারণে—মলদ্বার বন্ধ থাকা।
লেখকঃ ডাঃ অবিনাশ চন্দ্র রায়।
লেখকেরঃ গর্ভবতী মা ও সন্তান বই থেকে।
আরো দেখুনঃ শিশুদের সুন্দর নাম
আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কাছে ভালো লাগলে এটি শেয়ার করে আপনার বন্ধুদেরকে পড়তে সাহায্য করুণ…
The post নবজাত শিশুর যত্ন ও খাবার appeared first on Amar Bangla Post.