‘কলারূপে প্রেমের কথা শুনে অনেকে হয়তো চমকিয়ে উঠেছেন।
যে #প্রেম নিছক মানসিক ব্যাপার মাত্র, তাঁকে কিরূপে কলারূপে গণ্য করা যেতে পারে? এইরূপ তর্ক সূক্ষ্ম বিচার-শক্তির পরিচায়ক নয়। কর্তব্য সাধনের দ্বারা মানুষেরর সমস্ত বৃত্তিরই উৎকর্ষ সাধন করা যেতে পারে। মানুষের অন্যান্য অনেক বৃত্তির ন্যায় প্রেম বৃত্তিরও কেবল কর্ষণ করলে চলবে না, তা প্রদর্শন করাও মানব-কল্যাণের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। প্রেমের সাফল্য প্রেম আকর্ষণে। প্রেম যত গভীরই হোক না কেন, সুষ্ঠুরূপে প্রদর্শিত না হলে তা অন্ধকার পর্বত-গহ্ববরে সূর্য্যকান্ত-মণির মতই নিস্ফল। যাকে ভালোবাসিলাম, আমার ভালবাসার গভীরতা জানিয়ে যদি তাঁকে আনন্দ-দানই করতে না পারিলাম, তবে আমার ভাল্বাসার মূল্য কি? প্রেমের অজ্ঞাতে প্রেমিকের প্রাণে যে ‘আদর্শ’ প্রেমকে ‘গুমরিয়া মরিতে’ আমরা কবিতা পুস্তকে দেখে থাকি, সে ‘আদর্শ’ প্রেমের আমরা নিন্দা করতেছি না; তবে ঐরূপ প্রেমের দোষ এই যে আমরা ঐরূপ প্রেম সকলের জন্য ব্যবস্থা করতে পারি না। আমরা যে প্রেমের কথা বলতেছি, সে প্রেম মিলনান্তক নাটকের প্রেম—বিয়োগান্ত নাটকের নয়।
কলারূপে প্রেমের কর্ষণ দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর জীবনকে বাস্তবিকই অনেক-খানি রমন্তিক করা যেতে পারে। সেজন্য স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে যত-খানি ভাল বাসে, কাজে-কর্মে ভাবে-ভঙ্গিতে তাঁর সব-খানি প্রদর্শনত করিবেনই, উপরন্ত খানিকটা কৃত্রিম ও চেষ্টাকৃত হলেও পরস্পরের প্রতি সোহাগ-পূর্ণ ভালবাসা দেখানো উচিৎ। এই উদ্দেশ্যে অবিবাহিত প্রেমিক প্রেমিকার মত একে অপরকে পাওয়ার অসীম-প্রচেষ্টা, প্রেম-নিবেদন, চুম্বন, আলিঙ্গনাদি রতি-ক্রীড়া—এমত সহস্র উপায়ে বিবাহিত জীবনকে চিরমধুর করে রাখা সত্যিকার ও আন্তরিক প্রেম-স্ফুরণের পক্ষে অতীব উপযোগি।
কলারূপে প্রেমের আবশ্যকতা। আমাদের পারিভারিক জীবনের সাধারণ ইতিহাস
প্রেমের এই সমস্ত প্রদর্শনী এই জন্য প্রয়োজন যে, বিবাহ স্বামী-স্ত্রীকে সহজ-লভ্য করে ফেলায় পরস্পরের প্রতি আগ্রহের তীব্রতা সত্যই খানিকটা হ্রাস প্রাপ্ত হয়। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য সমস্ত প্রেম-শাস্ত্রই এ বিষয়ে একমত যে, #পরকীয়া ছাড়া প্রেম হতেই পারে না। ইউরোপীয় মনো-বৈজ্ঞানিক ও যৌন-বৈজ্ঞানিকগণ বহু গবেষণার দ্বারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, যে প্রেম বিবাহে পর্য্যবসিত হলো, সে প্রেম-কুসুম অকালে ঝড়ে পড়ে, বিবাহের এমন চরম অপবাদ আর হতে পারে না। কিন্তু অপবাদের ন্যায় শোনা গেলেও সত্য সত্যই আমাদের বিবাহিত জীবন একেবারে রোমান্স-বিহীন। তীব্র প্রেমে যে নায়ক-নায়িকা প্রাণবিসর্জন দিতে উদ্যত হয়েছিল, বহু বাধা-বিঘ্নের ভিতর দিয়ে বিবাহে তাঁদের মিলন সংঘটিত হওয়ার অল্পদিন পরেই তাঁদের প্রেমের তীব্রতার পরিসমাপ্তি ঘটে; তাঁরা অতঃপর কর্দ্দমাক্ত সংসার-পথে নিতান্ত কর্তব্য-বোধে প্রেম ও কবিতা-বিহীন জীবনের ঠেলা-গাড়ী ঠেলিতে থাকে; ইহাই আমাদের বিবাহিত জীবনের সাধারণ ইতিহাস।
এই শোচনীয় অবস্থার প্রতিকার করে আমাদের বিবাহিত জীবনকে রোমান্স ও কবিত্বপূর্ণ করার জন্য আমাদেরকে কলারূপে প্রেমের চর্চা করতে হবে। বাগান অরণ্যের মত প্রকৃত নয় সত্য, কিন্তু কৃত্রিম বাগানকে কি মানুষ সুন্দর করে নাই? #পরকীয়া প্রেমে অরণ্যের স্বাভাবিকত্ব থাকুক, কিন্তু বিবাহিত প্রেমকে আমাদের বাগানের সৌন্দর্য্য দান করতে হবে। যতই কৃত্রিম হোক তাতে আমরা পরকীয়া প্রেমরূপী অরণ্যের সৌন্দর্য্য উপভোগ করবো, কিন্তু তাঁহার হিংস্রজন্ত আমাদের অনিষ্ট করতে পারবে না।
প্রীতি-স্থাপনের কতিপয় উপকরণ
এতদ্ব্যতীত এমন সব ব্যাপারে দাম্পত্য-জীবনের সুখের ভিত্তি দৃঢ় হয়ে উঠতে থাকে, যা অপরের চক্ষে নিতান্তই তুচ্ছ মনে হতে পারে। প্রেম-পত্রের কথাই ধরা যাক। দীর্ঘ-দীর্ঘ প্রেম-পত্র অপরের নিকট হাস্যকর বাড়া-বাড়ি মনে হতে পারে, দম্পতির উভয়ের জ্ঞাত-সারেই তাতে অতিশয়োক্তি থাকতে পারে, তবু ঐ সমস্ত প্রেম-পত্রের মূল্য অনেকখানি। ঐ সমস্ত পত্রের অতিশোয়োক্তি উভয়ের অজ্ঞাতসারে উভয়কে পরস্পরের নিকট ঘনিষ্ট করে তোলে।
জন্ম-তিথি, পূজা-পার্বণ, ঈদ ইত্যাদি পর্ব উপলক্ষে পরস্পরকে উপহার দেওয়া, নিজেদের বিবাহ-দিবসকে স্মরনীয় করার চেষ্টা করা উভয়ের প্রতি উভয়ের প্রীতি ও মমতা বৃদ্ধি করে থাকে। পূজা বা ঈদের দিন যদি স্বামী তাঁর সাধ্যমত অর্থব্যয় করে একটি শাড়ী বা গহনা নিয়ে বাড়ীতে প্রবেশ করে কিম্বা একটি ফুলের মালাআ গলায় দিয়ে কিম্বা একটি নতুন সেলাই করা রুমাল হাতে দিয়ে বলে ‘জন্মদিনের উপহার’, তবে তাতে স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ক কতই-না মধুতর হয়।
আমরা পূর্বেই বলেছি যে, স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে কেবল ভালবাসিলেই চলবে না। ভালবাসা দেখাইতে হবে। তা সাধারণ অভিজ্ঞতার কথা যে, ভুল বুঝার দোষে বহু বন্ধুত্ব সম্পর্ক নষ্ট হয়ে থাকে। মানুষের মন দৃশ্য-বস্তু নয়। সুতরাং মনে মনে ভালবাসা থাকিলেও যাকে ভালবাসি তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। ভালবাসা প্রদর্শিত না হবার ফলে তাঁর মনে অভিমানের অন্ধকার জমাট বেঁধে অভিমান হতে ক্রোধ, ক্রোধ হতে ঘৃণা, ঘৃণা হতে অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা এবং অশ্রদ্ধা হতে শত্রুতা জন্মগ্রহণ করতে পারে। পক্ষান্তরে তাঁর সেই মনোভাব একটার পর একটা অপরের মনেও সংক্রমিত ও প্রতিফলিত হতে পারে। ভালবাসা প্রদর্শনের অভাবই সমস্ত ভুল বুঝার মূল কারণ। পক্ষান্তরে প্রদর্শিত ভালবাসার মধ্যে যদি খানিকটা বা ষোলআনা কৃত্রিমতাও থাকে, তবে ভালবাসার পাত্র হতে অকৃত্রিম ভালবাসা আকর্ষণ করে ক্রমে আমার কৃত্রিম প্রেমকে অকৃত্রিম প্রেমে উন্নীত করতে পারে।
পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা দাম্পত্য-জীবনে সুখের অন্যতম ভিত্তি। স্ত্রীকে যতই মূর্খ মনে করা হোক না কেন, সকল কাজে তাঁর পরামর্শ জিজ্ঞাসা করায় সাংসারিক শান্তি ও দাম্পত্য-প্রীতি বদ্ধিত হয়। বৈষয়িক ব্যাপারে স্বামী স্ত্রীকে যত অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করবে, স্ত্রীও তাঁদের বৈষয়িক ব্যাপারে ততই উদাসীন হয়ে পড়বে।
সামান্য ব্যাপারে খিট-খিট হওয়া দাম্পত্য-সুখের অনুকূল নয়। হলদে শাড়ীর বদলে চাঁপা রঙের শাড়ী আনিলেই যদি স্ত্রী মেজাজ দেখায়, কিম্বা তরকারীতে বেগুনের বদলে সীম দিলেই যদি স্বামী রাগ করে বসে, তবে সে দম্পতির জীবন কদাচ সুখের হতে পারে না। ফলতঃ সে সমস্ত ব্যাপার উপেক্ষা করিলে কোনো বিশেষ গোলমাল হয় না, সে সব ব্যাপারে পরস্পরের ক্রটি-বিচ্যুতি সহ্য করে যাওয়া নিতান্ত আবশ্যক।
শোকে সান্ত্বনা ও দুঃখে শান্তি দান করা দম্পতির পরস্পরের প্রতি পরস্পরের বিরাট কর্তব্য। আমাদের দেশে সমাজ ব্যবস্থার ফলে দুঃখ-কষ্টের চাপ পুরুষের উপর দিয়েই যায় বেশী। কিন্তু শিক্ষার অভাবে নারী তেমন অবস্থায় পুরুষকে যথাপোযুক্ত সান্ত্বনা দিতে পারে না। পক্ষান্তরে চীৎকার, কান্না-কাটি ও সোর-গোল করে পুরুষের বিপদের মাত্র আরও বাড়িয়ে দেয়।
জীবনের দুঃখ-কষ্ট আছেই, থাকবেই—কিন্তু সেগুলি সহ্য করার জন্য আমাদেরকে ধৈর্যধারণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমার যে হয়েছে, তাঁর অপেক্ষা গুরুতর বিপদ হতে পারতো। ‘অন্ধকারের পরেই আলো আসবে’, ‘দুঃখের পরেই সুখ’ এই সমস্ত মহাজন-বাক্য ও প্রাকৃতিক সত্য আমাদেরকে গুরুতর বিপদেও সান্ত্বনা দান করতে পারে। বিপদে এলিয়ে পড়া বিপদ হতে উদ্ধার পাওয়ার মোটেই অনুকূল নয়। বুদ্ধিমতী স্ত্রী এই ধরণের কথা বলে বিপদ চঞ্চল স্বামীকে সান্ত্বনা দিতে পারে।
স্ত্রী বস্তুতঃই স্বামীর গৃহিণী, সে গৃহের ‘লক্ষ্মী ও অধিষ্ঠাত্রী দেবী”। স্বামী যতই উপার্জন করুক, স্ত্রী যদি মিতব্যয়ী ও সুগৃহিণী না হয়, তবে হয় সংসার বিশৃঙ্খল ও বাড়ী-ঘর কদর্য্য থাকিবে, না হয় চরম বিলাসিতায় দারিদ্র্য দেখা দিবে। এরূপ অবস্থার স্বামী সংসার পরিচালনার ভার নিজে হাতে রাখিতে পারে; কিন্তু তাতে স্বামীর অন্যান্য কর্ম ব্যাহত হয়, এবং স্ত্রীর প্রতি অবিশ্বাস সূচিত হয়। তা দাম্পত্য-সুখের অনুকূল নয়! যে কোনও কারনেই হোক, যে স্বামী স্ত্রীকে সিন্ধুকের চাবি দিয়ে বিশ্বাস করতে পারে না, সে স্বামীর প্রতি স্ত্রীরই বা শ্রদ্ধা হবে কেন? শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের যেখানে অভাব, সেখানে কদাচ প্রেম জন্ম-পরিগ্রহ করতে পারে না।
আপনি পড়ছেন >> যৌন বিজ্ঞান বই থেকে।
লেখাটি পড়ে আপনার কাছে ভালো লাগলে এটি শেয়ার করুন।
The post কলারূপে প্রেম- প্রেমের আবশ্যকতা ও প্রীতি-স্থাপনের উপায় appeared first on Amar Bangla Post.