প্রশ্নঃ তোমার বাবা কি করেন?
উত্তরঃ আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেন!
:
সুরভী মায়ের দিকে সরুচোখে তাকিয়ে বললো, “মা, বাবা কি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন?”
জাহিদা বেগমের চোখ রক্তগরম হয়ে গেল। এ কোন মেয়ে? নিজের বাবাকে সন্দেহ করছে! এর শরীরে তো রাজাকারের রক্ত!
:
সুরভী মুচকি হেসে বললো, “ঠিকই ভাবছো মা। আমারও মনে হয় আমি রাজাকারের মেয়ে।”
জাহিদা বেগম কিছু বললেন না। পাগলদের সব কথায় আমল দিতে হবে এমন মাথার দিব্যি তাকে কেউ দেয়নি। কিন্তু এ মেয়ে তো বিপদে পড়বে! বাবার মেয়ে, বাবার মত একটু চালাক হবে না?
:
:
সুরভী হঠাৎ থমথমে গলায় বলে উঠলো, “মা, আমার মনে হয় তুমিও জানো বাবার ভেতর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ছিটেফোঁটাও নেই। হাজার হাজার গৃহহীন মানুষ রেললাইনে, ফুটপাতে, বস্তিতে কষ্ট পাচ্ছে – আর বাবা নিজের আস্ত একটা বাড়ি থাকতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ করা ফ্ল্যাটের ফরম জমা দিতে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধ কি একটি পেশা মা?”
:
জাহিদা বেগম আস্তে করে বললেন, “নেবে না কেন শুনি? সরকার দিচ্ছে, তাই নিতে যাচ্ছে। এমন তো না যে তোর বাবা ফুটপাতের লোকেদের থেকে ফ্ল্যাট কেড়ে নিচ্ছে!”
:
:
সুরভী মৃদু হাসলো।
“হ্যাঁ মা, সরকারই দিচ্ছে। কিন্তু আর কত? যারা সচ্ছল, তাদের কেন দিতে হবে? যাদের সত্যিই দরকার তাদের দিক। নাকি সরকারের চোখ কানা? সরকার কি গরীবদের চোখে দেখে না? বাবার মত যারা টাকাপয়সা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে তাদের জন্যই দেখি সরকারের দরদ উথলে ওঠে বেশি!”
:
জাহিদা বেগম রেগে গেলেন।
“দরদ আছে বলেই উনি সরকার বুঝলি! তোর মত মাথামোটা না। মাঝে মাঝে অবাক হই, চালাক বাবা-মায়ের গাধাকন্যা কিভাবে জন্ম নিলো!”
:
:
সুরভী হাসলো।
“হ্যাঁ মা, আমি সত্যিই বোকা। আর তোমার সরকার মহাচালাক।
ওই যে একবার ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিল সরকার, মনে আছে মা?
সরকার ভেবেছিল চাষার ছেলে, কাজের মেয়েরাও চান্স পাচ্ছে। এটা তো হতে দেওয়া যায় না। এলিট ক্লাসে শুধু এলিটরাই থাকবে।”
:
— “কি বলছিস তুই?” জাহিদা বেগম চোখ কপালে তুললেন।
____ ‘হ্যাঁ মা, ঠিকই বলছি। ভর্তি পরীক্ষা না হলে ইচ্ছেমত প্রভাবশালীদের ছেলেপেলেকে ভর্তি করাতো। পত্রিকায় দেখলে না, জেলা প্রশাসকের মেয়েকে বার নাম্বার বেশি দিয়ে বৃত্তি পাইয়ে দিল!
যারা ক্লাস ফাইভের পরীক্ষায় এমন করতে পারে, তারা মেডিকেল ছেড়ে দেবে ভেবেছো? বোর্ডের কারসাজিতে কেউ যদি বেশি মার্কস পায়, তোমার মত জাহিদা বেগমের কি সাধ্য সেটা ধরবে? আর চাষাভুষাদের কথা না হয় বাদই দিলাম।”
:
:
সুরভী থামছে না। জাহিদা বেগম ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে আছেন।
____ “তবে কি জানো মা, এই সরকার যখন মনস্থির করেই ফেলেছে তখন এর শেষ দেখেই ছাড়বে। ওই যে, আন্দোলন করে পরীক্ষা আবার চালু হল। দুই বছর পর কি হল? বাজার দরে প্রশ্নফাঁস হল। এ থেকে কি কিছুই প্রমাণিত হয় না মা?”
— ‘কি প্রমাণিত হয়? আর এতে সরকারের হাত কোথায়?’
____ “সরকারের হাত খুঁজে পেলে না? মা, সরকার ভেবেছে দাঁড়া বাঙ্গালী, এবার তোরাই বলবি – প্লিজ,ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ করুন। প্রশ্নফাঁস থেকে বাঁচান। খুঁজে পেলে হাত? মা, এই সরকারের মত অতিচালাক সরকার পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। এই সরকার চাইলে প্রশ্নফাঁস আটকাবে না – পৃথিবী উল্টে গেলেও আমি এটা মানবো না।”
:
সুরভী একটু থেমে বললো,
“ফাইভের কচি খোকারাও আজ প্রশ্ন কিনে এক্সাম দেয়। কেন মা, সরকার কি এতটাই ব্যর্থ? না তাদের সদিচ্ছা ব্যর্থ?”
:
:
জাহিদা বেগম তাকিয়ে আছেন। এ সত্যিই সুরভী তো?
____ “জানো মা, আজ প্রতিটা পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা কোঠা। টাকাপয়সা, বাড়িঘর দেয়া যায় – তা বলে মেধাও কি দিতে হবে? একটা ছেলে কম নাম্বার পেয়েও মুক্তিযোদ্ধার নাতি হওয়ায় চান্স পেল। আরেকজন বেশি নাম্বার পেয়েও পেল না। তার কী অপরাধ? তার বাবার একটা সার্টিফিকেট নেই বলে? তার মায়ের জন্ম যুক্তিযোদ্ধার ঘরে হয়নি বলে? জন্মই কি তার আজন্ম পাপ?”
:
:
____ “তবে কী জানো তো মা, দেশের সরকারী চাকুরেদের বেতন এক লাফে দ্বিগুণ করে সরকার এদের নপুংসক বানিয়ে দিয়েছে। পুলিশ-প্রশাসন, বিসিএস ক্যাডার, সরকারী সকল কর্মচারীরা কৃতজ্ঞতায় এমন হয়েছে যে এরা গু দিলে গুও খাবে। চোখ মেলে দেখবেও না। এই প্রথম শ্রেণীর কর্তারা চাইলে, তারা নিরবিচ্ছিন্ন আন্দোলন করলে কি আজ তনুর বিচার হতো না মা, বলো?”
:
:
জাহিদা বেগম জবাব দিলেন না।
সুরভী উঠতে উঠতে বললো,
“আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস মা। ভাগ্যিস, এ যুগের কেউ ছিল না তখন। থাকলে আজকের দিনটাকে নপুংসক বুদ্ধিজীবী দিবস গণ্য করা হতো।”
:
জাহিদা বেগম জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। মেয়েটা কি দ্রুতই না বড় হয়ে গেল! আচ্ছা, তার মেয়েটা কি পারবে অন্ধকার কাটাতে? ভয় হয়, বড্ড ভয় হয়।
#সব_চরিত্র_কাল্পনিক
লিখেছেনঃ অনামিকা খুশবু অবনী
The post বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেন! appeared first on Amar Bangla Post.