ধৃতরাষ্ট্র-জায়া গান্ধারী শতপুত্রের জননী। কিন্তু সেই শতপুত্র একই সঙ্গে তাঁর জরায়ুতে বিকশিত হয়নি। গর্ভশয্যায় সাধারণত একটিমাত্র শিশু বিকশিত হয়। কিন্তু একাধিক শিশু, যথা—দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয় এমন কি ন’টি পর্যন্ত শিশুও গর্ভাধারে একই সঙ্গে বিকশিত হয়ে ভূমিষ্ঠ হওয়ার ঘটনাও জানা যায়।
ভারতবর্ষে ৮০ জন গর্ভবতী স্ত্রীর মধ্যে একজনের সন্তান হয়। যজম সন্তানের প্রাধান্য আফ্রিকার নিগ্রোদের মধ্যে সর্বাধিক। সেখানে প্রতি উনিশজন গর্ভবতী স্ত্রীর একজনের যমজ সন্তান ভূমিষ্ট হয়। তবে জাপানে এই প্রবণতা কম। সেখানে প্রতি ১৫৫ জন গর্ভিণীর মধ্যে ১ জনের যমজ সন্তান হয়।
যমজ সন্তান কেন হয়?
√ বংশগত কারণ : গর্ভিণীর মায়ের দিকে যমজ সন্তান হওয়ার ঘটনা থাকলে তারও যমজ সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
√ জাতগত কারণ : কোনো কোনো জাতের মধ্যে (যেমন আফ্রিকার নিগ্রোদের মধ্যে) যমজ সন্তান বেশি হয়।
√ বয়স : মায়ের বয়স ৩০-৩৫ বয়সে যমজ শিশু হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
√ গর্ভ : পঞ্চম গর্ভ ও তাঁর পরে যমজ সন্তান হওয়ার আধিক্য দেখা যায়।
√ ওষুধের প্রভাব : যেসব মায়েরা অনুর্বরতা রোগে ভোগেন, তাঁদের কারও কারও ডিম্বাশয় থেকে মাসে মাসে সঠিক সময়ে ডিম্ব নিঃসরণ হয় না। এক্ষেত্রে ডিম্ব নিঃসরণের জন্য ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। যেমন—ক্লোমিফেন সাইট্রেট, গোনাডোট্রোফিন ইত্যাদি। এসব ওষুধের প্রভাবে একই সঙ্গে একাধিক ডিম্ব নিঃসরণ হতে পারে। ফলে শুক্র দ্বারা একাধিক ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়ে দুই বা ততোধিক ভ্রূণ সৃষ্টি হয়।
বহু ক্ষেত্রে যমজ সন্তান লাভে একবারেই ঈস্পিত সন্তান সংখ্যার জন্য গর্ভিণীর ইচ্ছাপূরণ হলেও গর্ভাবস্থা, প্রসব ও প্রসবের অব্যবহিত পর মায়ের যে-সমস্ত শারীরিক সমস্যা ও জটিলতার সৃষ্টি হয় তাও কম নয়।
যমজের প্রকারভেদ
যমজ দু’প্রকারের হয়। যথা—
√ মনোজাইগোটিক : যে ক্ষেত্রে একটিমাত্র শুক্রাণু একটিমাত্র ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে যমজ সন্তান হয়। এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে এটা হয়।
√ ডাইজাইগোটিক : দুটি শুক্রাণু যখন দুটি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে যমজ সন্তান হয়, তাঁকে ডাইজাইগোটিক যজম বলে। দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে এটা হয়। যজম শিশু অধিকাংশ ক্ষেত্রে কন্যা।

কিভাবে যমজ গর্ভ বোঝা যায়
পরিবারের অন্য কারও, বিশেষ করে মায়ের দিকে যমজ সন্তান থাকলে মা’র অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি, গর্ভাবস্থার শেষ মাসগুলিতে শ্বাসকষ্ট ও বুক ধড়ফড় করা, রক্তাল্পতা, অতিরিক্ত বমি, গর্ভাবস্থার জন্য উচ্চরক্তচাপ—এসমস্ত ছাড়াও পেট অস্বাভাবিকভাবে বড় হওয়া, মায়ের পেটে হাত দিয়ে শিশুর অনেক বেশি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অনুভব করা ও দুটি হার্টের স্পন্দন শুনতে পেলে যমজ সন্তান রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। আলট্রাসাউন্ড নামক যন্ত্রের সাহয্যে যমজ শিশুর উপস্থিতি সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়।
আরও অন্য যে-কারণে যমজ গর্ভাবস্থার মতো মনে হতে পারে, তা হল—গর্ভে একটি বড় বাচ্চা, জরায়ুতে বেশি পানি, গর্ভাবস্থার সঙ্গে ডিম্বাশয়ের বড় টিউমার অথবা জরায়ুর টিউমার (ফাইব্রয়েড)।

যমজ শিশুর পেটের ভেতর অবস্থিতি
৪৫ শতাংশ ক্ষেত্রে উভয় শিশুরই মাথা নীচের দিকে থাকে। ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রথম শিশুর মাথা নীচে ও দ্বিতীয়টির পাছা নীচে থাকে। ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রথমটির পাছা নীচেও দ্বিতীয়টির মাথা নীচে থাকে। আরও ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে দুটি শিশুরই পাছা নীচের দিকে থাকে, ইত্যাদি।
একাধিক শিশু গর্ভে থাকলে তাঁর জন্য শিশুর ওপর প্রভাব
- গর্ভপাতের সম্ভাবনা বেশি।
- প্রায় ৯০ শতাংশ শিশু কম ওজনের হয়।
- বিকলাঙ্গ (conjoined or Siamese twin) জন্ম নিতে পারে। এটা যে যে ধরনের হয়, তা হল—
- Pyopagus : যখন দুটি শিশুর পশ্চাদদেশ জোড়া লেগে থাকে।
- Thoracopgus : যখন দুটি শিশু ছাতিতে জোড়া লেগে থাকে।
- Craniopagus : যখন মাথাতে জোড়া লেগে থাকে।
- Omphalopagus : যখন পেটে জোড়া লেগে থাকে।

যখন সন্তান গর্ভে থাকলে মায়ের শরীরে পরিবর্তন
- জরায়ুর আয়তন অত্যধিক বৃদ্ধি পায়।
- রক্তের আয়তন প্রায় ৫০ শতাংশ (৫০০ মিলিলিটার) বৃদ্ধি পায়।
- কারডিয়াক আউটপুট বৃদ্ধি পায়।
- কিডনির কার্যকারিতার ব্যাঘাত ঘটে গর্ভাবস্থায় জরায়ুর চাপের জন্য।
যমজ গর্ভাবস্থার জটিলতা
- গর্ভপাত বেশি হয়।
- খনিজ লৌহ ও ফলিক অ্যাসিডের অভাবজনিত কারণে রক্তাল্পতা দ্বিগুণ হয়।
- ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থার জন্য উচ্চ রক্তচাপ হয়।
- ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে জরায়ুতে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় (Hydramnios)।
অন্যান্য উপসর্গ
পা ফুলে যাওয়া, ভেরিকোজ ভেন হওয়া, অর্শের জন্য কষ্টবৃদ্ধি, প্রসবের আগে ও গর্ভাবস্থার শেষ মাসগুলিতে জরায়ু থেকে রক্তক্ষরণ, সময়ের আগেই গর্ভযন্ত্রণা শুরু হওয়া ও প্রসব হওয়া, বয়স অনুযায়ী কম ওজনের শিশুর জন্ম ও জন্মগত ক্রটিসম্পন্ন শিশুর জন্ম হওয়া।
প্রসবের সময় জটিলতা
জরায়ুর কাজ কর্ম স্বাভাবিক থাকে না। জরায়ুর নিয়মিত স্বাভাবিক সঙ্কোচন থাকে না। শিশু জন্মের আগেই নাড়ি (Umbilical cord) যোনি দিয়ে নির্গত হতে পারে। শিশুদ্বয়ের অস্বাভাবিক অবস্থিতি প্রসবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। প্রসবের পর রক্তক্ষরণ খুব বেশি হতে পারে (P.P.H.) । রোগী আচ্ছন্ন অবস্থায় চলে যেতে পারে। গর্ভের ফুল গর্ভশয্যা থেকে নির্গত না হওয়ার জন্যও (Retaoned placenta) খুব বেহসি মাত্রায় রক্তক্ষরণ হতে পারে।

যমজ গর্ভাবস্থা সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী
এটি একটি বেশি বিপদের গর্ভাবস্থা। এক্ষেত্রে মায়ের মৃত্যুর বিপদ অনেক বেশি। যে কারণে সচরাচর মৃত্যু হয় তা হল জরায়ু থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ।
শিশুমৃত্যুও চারগুণ বেশি হতে পারে। শিশুমৃত্যুর কারণগুলি হল : কম ওজনের শিশুর জন্ম হওয়া, জন্মের অব্যবহিত পরে শ্বাসকষ্ট, বয়স অনুযায়ী কম ওজনের শিশুর জন্ম (I.U.G.R.), জন্মগত ক্রটি ও বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম ও সংক্রমণ ইত্যাদি। এইজন্য যমজ গর্ভের মায়েদের ভালো চিকিৎসালয়ে প্রসব করানো উচিত।
যমজ গর্ভের মায়েদের পরিচর্যা
এক্ষেত্রে ঘন-ঘন এবং খুব ভালো করে গর্ভাবস্থায় পরিচর্যা করা হয়। পর্যাপ্ত খাদ্য, বিশ্রাম, লৌহ ও ফলিক অ্যাসিড খাওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়। রোগীকে সাধারণত গর্ভের ৩৮ সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
শিশুর যত্ন
কম ওজনের এবং সময়ের আগেই প্রসব হওয়া শিশুর চিকিৎসার ভালো ব্যবস্থা আছে, এমন intensive neonatal care nursery-তে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
বুকের দুধ পান
একই সঙ্গে শিশুকে দুধপান করানো হয়। যদি বুকের দুধ অপর্যাপ্ত হয়, তাহলে অতিরিক্ত দুধ, যথা—গরুর বা কৌটোর দুধ দেওয়া যেতে পারে।

লেখকঃ ডাঃ অবিনাশ চন্দ্র রায়।
লেখকের গর্ভবতী মা ও সন্তান বই থেকে।
The post যমজ সন্তান গর্ভধারণ। যমজ সন্তান কেন হয় ও মায়ের পরিচর্যা appeared first on Amar Bangla Post.