সিজারিয়ান অপারেশনের পর নবজাতকের মুখ দেখে অনেকেই সুখে-শান্তিতে আছেন।
কিন্তু এই অপারেশন যখন হত না, তখন কি হত সেকথা জানলে অবশ্যই সিউরে উঠবেন। বিশ্বব্রহ্হ্মাণ্ড সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে গর্ভধারণ ও প্রসব হয়ে আসছে। সৃষ্টির অনাসৃষ্টির কারণে যখন প্রসব-পথে অর্থাৎ জরায়ুর নিম্নভাগে বা মুখে অথবা যোনিতে জন্মগত বা পরবর্তীকালে নানান রকম বাঁধার সৃষ্টি হয়। [যথা—জরায়ুর মুখ বা যোনিপথ জন্মগত বা পরবর্তীকালে অসুখের জন্য বন্ধ হয়ে থাকা অথবা বিকৃত বা ছোট শ্রোণী (Pelvis) জন্মগত বা রিকেটের জন্য] তখন স্বাভাবিক পথে প্রসব কিছুতেই হবে না। ভাবুন তো সেসময়ে কী হত!
জরায়ুতে পূর্ণবিকশিত জাতক নিয়ে মা গর্ভ-যন্ত্রণায় কষ্ট পাওয়ার পর মৃত্যুর দিন গুনতো আর শিশু জগতের আলো দেখার আগে জরায়ুতেই মারা যেত।
সম্ভাব্য আরও যেসব সমস্যার সৃষ্টি হত, তা হল—জরায়ু ফেটে পেটের ভেতর রক্তক্ষরণ, সংক্রমণ ও ফলস্বরূপ অনির্বায মৃত্যু। আর যখন যোনিপথে বাঁধা থাকত, তখন শিশুর মাথা ও শ্রোণীর সামনের দিকের হাড়ের মধ্যে নিস্পেষিত হয়ে প্রস্রাবথলির কিছু অংশের পচন (Necrosis) হত এবং তা গলে পড়ত। ফসস্বরূপ প্রস্রাবথলি ও যোনির মধ্যে সংযোগ (vasico vaginal fistula) এবং অনবরত যোনি দিয়ে প্রস্রাব নিঃসরণ—সে এক মর্মান্তিক কষ্টকর অবস্থা।
সিজারিয়ান অপারেশন বলতে বোঝায় গর্ভের সাত মাস সম্পূর্ণ হওয়ার পর পেট ও জরায়ু কেটে বাচ্চার প্রসব করানো। শল্যচিকিৎসার ক্ষেত্রে এটি একটি বহু পুরাতন অপারেশন। এই অপারেশনের সর্বপ্রথম কখন হয় তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। সিজারিয়ান কথাটা কোথা থেকে এল বা কেন ব্যবহার করা হয়, এই নিয়ে চিকিৎসা-বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের ধারণা : কাঁচি অর্থাৎ সিজার দিয়ে এই অপারেশন হয় বলেই এটাকে সিজারিয়ান বলা হয়। তা অবশ্য ঠিক নয়।
খ্রীঃ পৃঃ ৭১৫ সালে রোমে একটি আইন জারি করা হয়। তাঁর নাম ‘লেক্স সিজারিয়া’ (Lex-caesarea)। সেই আইন অনুযায়ী কোনো গর্ভবতী মহিলার মৃত্যু যখন সমাসন্ন অর্থাৎ যখন তাকে বাঁচানো কিছুতেই সম্বব নয়, তখন তাঁর বাচ্ছাকে বাঁচানোর আশায় পেট কেটে বার করতে হবে। তাছাড়া গর্ভাবস্থায় মৃত্যু হলে তাঁর পেট কেটে বাচ্চাকে বার না করে কবরস্থ করা চলবে না। সিজারের রাজত্বকালে এই আইন বলবত ছিল। সুতরাং সিজারের জন্ম এই উপায়ে হয় তাঁর জন্য এই অপারেশনের নাম সিজারিয়ান—তা ঠিক নয়। কারণ সিজারের জন্ম হওয়ার পরও তাঁর মা অনেক দিন বেঁচে ছিলেন।
সিজারের কথাটা সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন ডেমেস গুলিমিউ। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফরাসি ধাত্রীবিদ্যা-বিশারদ এফ. মরিসিউ জীবন্ত স্ত্রীলোকের ওপর এই অপারেশনের কথা ঘোষণা করেন। তখন জরায়ু কেটে বাচ্চা বের করার পর তা সেলাই করা হত না। ফলে উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে (১৮৭০ সাল নাগাদ) এই অপারেশনের পর ৮০ শতাংশেরও বেশি নারী মারা যেত, মুখ্যত কাঁটা জরায়ুর জায়গা থেকে রক্তক্ষরণের জন্য। কারণ পূর্ণ বিকশিত গর্ভাবস্থায় জরায়ুর মধ্যে রক্তসঞ্চলন ১৫ গুণ বেড়ে যায়, প্রতি মিনিটে প্রায় ৭৫০ মিলিলিটার।
তখনকার দিনে সার্জেনরা বিশ্বাস করতেন যে, জরায়ু সেলাই করলে সেলাই করার পদার্থ পেটের ভেতরে পেকে যাওয়ার বিপদ ডেকে আনবে।
১৮৭৬ খৃস্টাব্দে ইতালির ডাক্তার পোরো এই অপারেশনের সময় জরায়ুর ওপরের অংশ কেটে বাদ দিতে শুরু করেন এবং নীচের অংশ পেটের ক্ষতের নিম্নভাগে বার করে রাখতেন, যাতে সেখান থেকে রক্তক্ষরণ বাইরে থেকে চাপ দিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হয়। সঙ্গে সঙ্গে মায়েদের মৃত্যু আগের পরিসংখ্যানের অর্ধেক হয়ে যায় অর্থাৎ ৪০ শতাংশে নেমে আসে। কারণ জরায়ু সেলাই না করার জন্য রক্তক্ষণের বিপদ আর রইল না এবং সংক্রমণের বিপদও কমে এল।
১৮৮১ খ্রীস্টাব্দে জার্মানির ডাক্তার কেরার সর্বপ্রথম এই অপারেশনের জরায়ু সেলাই করা শুরু করেন। ১৮৮২ খ্রীস্টাব্দে স্যাংগার জরায়ু সেলাই করা পদ্ধতি শুরু করেন এবং তাঁর উপকারিতা প্রমাণ করেন। জরায়ু সেলাই করা ব্যাপারটা সিজারিয়ান অপারেশনের পদ্ধতির ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
এতদিন পর্যন্ত ওপরের দিক ওপর থেকে নীচে লম্বালম্বিভাবে কাটার জন্য রক্তক্ষরণ ও সংক্রমণ বেশি হত, ফলে মৃত্যুর হারও বেশি ছিল।
১৮৮১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর কেরার সর্বপ্রথম জরায়ুর নীচের অংশে আড়াআড়িভাবে (Transverse) কেটে অপারেশন করেন এবং সেইভাবেই এখনও অপারেশন করা হয়। সেইজন্য তাঁকে Lower segment অপারেশনের জনক বলা হয়।
১৯২৬ খ্রীস্টাব্দে মুনরোকার এই পদ্ধতিতে অপারেশন শুরু করেন এবং তা জনপ্রিয় ও সবার গ্রহণযোগ্য করে তোলেন।
গর্ভযন্ত্রণা লাঘবের জন্য বা অপারেশনের জন্য দরকার সাময়িক অপারেশন শুরু করেন এবং তা জনপ্রিয় ও সবার গ্রহণযোগ্য করে তোলেন।
১৮৪৭ সালের ১৯ জানুয়ারি ডাঃ জেমস ইয়ং সিমসন নামক এক সাধারণ ও অখ্যাত ডাক্তার সর্বপ্রথম একজন গর্ভবতী মহিলার ওপর অজ্ঞান করার জন্য ইথার (Ether) প্রয়োগ করেন। এর জন্য তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। বিশেষ করে গোঁড়া মৌলবাদী, ধর্মযাজকরা তাঁর নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠে। এতে ডাঃ সিমসন মনে আঘাত পেলেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। শত আবেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে অল্পদিন পরেই তিনিই সর্বপ্রথম ১৮৪৭ সালের ৮নভেম্বর অতি যত্নের সঙ্গে ক্লোরোফর্ম ব্যবহার শুরু করেন, যাতে রোগীকে পুরোপুরি অজ্ঞান করা যায় অপারেশন করে প্রসব করাতে অথবা প্রসব-যন্ত্রণা লাঘব করতে। মাঝে মাঝে ওষুধ শোঁকানো পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যাতে রোগিণী সচেতন থাকেন, কিন্তু তাঁর বেদনার অনুভুতি না থাকে। এর উপকারিতার প্রমাণের একটা মস্ত বড় সুযোগ এসে গেল। মহারানী ভিক্টোরিয়ার অষ্টম গর্ভের সন্তান প্রসব হবে। গর্ভযন্ত্রণা লাঘবের জন্য মহারাণীর ওপর ওই ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। মহারাণী উপকৃত হলেন এবং স্বভাবত খুব সন্তুষ্ট হলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই খবর দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং গর্ভাবস্থায় অপারেশনের জন্য এর ব্যবহার বেড়ে যায়। অখ্যাত এক সাধারণ ডাক্তার সিমসন খ্যাতির শীর্ষে উঠলেন এবং তাঁকে ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করা হল।
অজ্ঞান করার ব্যবস্থা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অ্যান্টিবায়োটিকের আবিস্কার ও ব্লাডব্যাঙ্ক সেবা চালু হওয়ার পর এই অপারেশন অনেকটাই নিরাপদ হয়েছে। তাই মোটামুটি অর্ধশতাব্দী থেকে এই অপারেশন ক্রমশ এগিয়ে চলেছে—এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায়।
পশ্চিমের উন্নত দেশগুলিতে এখন সিজারিয়ান অপারেশনের পর মৃত্যু হয় হাজারে এক থেকে-দুই এর মধ্যে। আমাদের দেশে তা এক থেকে দুই শতাংশ। স্বাভাবিক ভাবে প্রসব হওয়া থেকে সিজারিয়ান ডেলিভারির জন্য মৃত্যু সাত থেকে দশ গুণ বেশি।
সিজারিয়ান অপারেশন মুখ্যত যেসব কারণে করতে হয়, তা হল পূর্বে সিজারিয়ানের পর গর্ভধারণ, দীর্ঘায়িত প্রসব যন্ত্রণা, জরায়ুর ভেতর শিশুর অস্বাভাবিক অবস্থান, প্রসবের পূর্বে জরায়ু থেকে রক্তক্ষরণ, জরায়ুর ভেতর বাচ্চার হাঁপিয়ে ওঠা বা শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়া, শিশুর মাথার তুলনায় ছোট শ্রোণী, গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ তথা শরীর ফুলে যাওয়া, গর্ভাবস্থায় বিপজ্জনক রোগসমূহ; যেমন—ডায়াবেটিস, হার্ট তথা কিডনির অসুখ ইত্যাদি।
ভারতবর্ষে সিজারিয়ান ডেলিভারি হয় পাঁচ থেকে দশ শতাংশ এবং এই পরিসংখ্যান ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। পশ্চিমের উন্নত দেশে তা ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ বা আরও বেশি।
বর্তমানে সিজারিয়ান ডেলিভারির দিকে প্রবণতা বৃদ্ধির মুখ্য কারণ হল শিশু ও মায়ের সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা যথাসম্ভব সুনিশ্চিত করা। আগে এটা ছিল একটা বিকল্প উপায় মাত্র অর্থাৎ স্বাভাবিক ভাবে প্রসব করানোর সবরকম চেষ্টা ব্যর্থ হলে তবেই পেটে কেটে ডেলিভারি করানোর কথা চিন্তা করা হত (vaginal by-pass) ।
তাছাড়া বর্তমানে ছোট পরিবারের কথা ও নিরাপদ মাতৃত্বের কথা চিন্তা করে বেশি বিপদের ঝুঁকি নেওয়া হয় না। একটি অথবা দুটি সন্তান হোক এবং তা সুস্থ হোক—এটাই সবাই চায়। এখন একটা কথা খুবই শোনা যায় যে, ডাক্তারবাবুরা কথায় কথায় সিজার করে দেন। এটা পুরোপুরি সত্য নয়। বাবা-মা’র এক আদুরে কন্যা বা স্বামীর প্রাণাধিক প্রিয়া স্ত্রী যখন গর্ভযন্ত্রণায় কষ্ট পায় এবং প্রসবপর্বে নানান বিপত্তির কারণে যখন স্বাভাবিক প্রসব হতে দেরি হয়, তখন আদুরে মেয়েও তাঁর স্বামী অথবা তাঁর পিতা-মাতার কথা সহৃদয় ডাক্তারবাবু উপেক্ষা করবেন কী করে? কথা কথায় আর কত দেরি করবেন? কারণ ডাক্তারবাবু জানেন যে, যোনিপথের ৮ সেন্টিমিটার পত অতিক্রম করতে একটি শিশু যে মৃত্যুর বিপদ বা ঝুঁকির মধ্য দিয়ে পার হয়, তা তাঁর বাকি ৮০ বছরের জীবনের বিপদ, দুর্ঘটনা বা মৃত্যুভয় থেকে কোনো অংশে কম নয়।
- সিজার অপারেশনের কতক্ষণ বাদে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানী হয়?
- ৪ থেকে ৬ ঘন্টা বাদে শিশুকে বুকের দুধ দেওয়া হয়, সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে।
- কতক্ষণ বাদে মা হাঁটাচলা শুরু করতে পারেন?
- অপারেশনের চব্বিশ ঘন্টা বাদেই মা নিজ হাঁটাচলা করতে পারবেন।
- পেটের সেলাই কতদিন বাদে সাধারণত কাঁটা হয়?
- সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে ছ’দিনের দিন সেলাই কেটে সপ্তম দিনে রোগীকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া যায়।
অপারেশনের জন্য মায়ের মৃত্যু
রোগীর শারীরিক অবস্থা ভালো থাকলে এই অপারেশনের জন্য মায়ের মৃত্যু এক হাজারে দু’জনার বেশি নয়। কিন্তু যখন রোগীর শারীরিক অবস্থা ভালো নয়, তখন মৃত্যুহার ০.৫ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে।
মৃত্যুর কারণগুলো হল এই রকম—
* রক্তক্ষরণ
* পেরিটোনাইটিস
* অজ্ঞান করার কারণে মৃত্যু ও পালমোনারি এমবলিসম।
শিশুমৃত্যু
শিশু মৃত্যুর হার ৫ থেকে ১০ শতাংশ। মৃত্যুর কারণগুলি হলঃ
- অ্যাসফিক্সিয়া (শ্বাসকষ্ট)
- আর.ডি.এস (Respiratory distress syndrome)
- শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ না হওয়ার জন্য।
- সংক্রমণ।
- মস্তিঙ্কের ভেতর রক্তক্ষরণ ইত্যাদি।
জীবনের যাত্রার শুরুতে লেবাররুম থিয়েটার বা অপারেশন থিয়েটারে যে জীবন-মৃত্যুর থিয়েটার বা পালা শুরু হয়, তা খুবই ঘটনাবহুল, বৈচিত্র্যপূর্ণ, উত্তেজনাপূর্ণ ও টেনশন-মাখানো। সিজারিয়ান অপারেশনের সময় রক্ত, ছুরি, কাঁচি ও যন্ত্রপাতি নিয়ে খেলা করে একজন দক্ষ ডাক্তার তাঁর মনের মাধুরী মিশিয়ে সূচিশিল্পের নৈপুণ্য বা দুই হাতের আঙুলের যা খেলা দেখান, তাতে শিল্পকলা বা শিল্প-নৈপুণ্যের কোনো ঘাটতি থাকে না। শুধু পেটের দাগ, তা নাভির নীচে লম্বালম্বিভাবেই থাকুক বা তলপেটের একেবারে নীচের দিকে আড়াআড়ি ভাবেই থাকুক, সেই চিহ্নই সার্জেনের ছুরি, কাঁচি ও সূচিশিল্পের সাক্ষী বহন করে চলে।
লেখকঃ ডাঃ অবিনাশ চন্দ্র রায়।
লেখকেরঃ গর্ভবতী মা ও সন্তান বই থেকে।
আরো দেখুনঃ সিজারিয়ান অপারেশন ভিডিও ►
The post সিজারিয়ান অপারেশন। জেনে নিন যেসব কারনে এই অপারেশন করা হয় appeared first on Amar Bangla Post.