শিক্ষাকে আমরা জাতির মেরুদণ্ড জ্ঞান করি।
সে শিক্ষা নারীর হোক বা পুরুষের। পৃথিবীতে শিক্ষাবিদ্বেষী কোনো লোক আছে বলে আমার জানা নেই। তবে শিক্ষাটা কোথায় হচ্ছে, কারা দিচ্ছেন এবং শিক্ষার ফলাফলটা কী হচ্ছে- তা ভেবে দেখা বা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা কিন্তু মোটেই অযৌক্তিক নয়। কোনো শিক্ষাব্যবস্থায় যদি নারীর সম্ভ্রম হারানোর ব্যবস্থা থাকে কিংবা সম্ভ্রম রক্ষার নিশ্চয়তা না থাকে তবে সেই ব্যবস্থাকে জাতির মেরুদণ্ড বললে ইনসাফ করা হবে কিনা- সেটাও কিন্তু ভেবে দেখা আমাদের দায়িত্বের আওতায় পড়ে। আমরা সেই দায়িত্ব পালন করছি কিনা এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান হালতের ওপর সন্তুষ্ট থাকা যায় কিনা সে যাচাইয়ের জন্য নিম্নে কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরছি।
‘ঘটনা : ১
এক তরুণ আলেমের বক্তব্য। একদিন তিনি টঙ্গীর স্টেশন রোড থেকে বেবি ট্যাক্সিতে ওঠেন কামারপাড়ার উদ্দেশে। তার মুখোমুখি সিটে বসা এক তরুণের সঙ্গে দুই তরুণী। ইজতেমা-ময়দানের পাশ দিয়ে ট্যাক্সি চলা শুরু করার খানিক বাদে তরুণীদ্বয়ের একজন আচমকা ওই আলেমকে জিজ্ঞেস করেন, ‘হুজুর, কিছু মনে না করলে আপনার মোবাইল নাম্বারটা আমাকে একটু দেবেন।’
-কেন? জানতে চান ওই আলেম।
-আমার কিছু প্রাইভেট প্রশ্ন আছে। আমি একান্ত ভাবে তা আপনার কাছ থেকে জেনে নেব। বললেন তরুণী।
একটা ট্যাক্সিতে বসে এভাবে অপরিচিত একজন তরুণীকে নাম্বার দেয়াকে উচিত মনে করলেন না তিনি। তার ইতস্ততা দেখে তরুণীর কণ্ঠ থেকে অনুরোধ ঝড়ে পড়লো, ‘আপনি আমার বড় ভাইয়ের মতো। ভয়ের কারণ নেই। একটি সমস্যার সমাধানের জন্য আপনার সাথে খোলাখুলি কিছু কথা বলা দরকার বলে নাম্বারটা চাইছি। যদি মোবাইল নাম্বার না দিতে চান তবে অন্তত গাড়ি থেকে নেমে মিনিট পাঁচেক সময় দেবেন আমাকে। আমি মানসিকভাবে খুবই অশান্তিতে আছি, দয়া করে আপনি আমাকে হতাশ করবেন না।’
একজন মানুষের এত কাকুতি-মিনতি দেখে না করে পারা যায় না। তাই তিনি তাকে সময় দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং ট্যাক্সি থেকে নেমে তার সমস্যার কথা জানতে চাইলেন।
তরুণীটি যে সমস্যার কথা বললেন, তার সূত্রপাত কবে ঘটেছে, এর গভীরতা কত- তা আমাদের মতো ঘরকুনে লোকের পক্ষে জানা কঠিন। আমরা শুধু দূর থেকে অনুমান করতে পারি কিন্তু গভীরতা যাচাইয়ের মতো ডুবুরীর দৃষ্টিতো আমাদের চোখে নেই। তাই মেয়েটির কথা ও সমস্যা সমাজের আরও দশটি ঘটনা ও সমস্যার প্রতিনিধিত্ব করলেও তরুণ আলেম তা শুনে বেদনায় থমকে গেলেন। মেয়েটি বললেন- ‘বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে লিভ টুগেদার করায় পেটে সন্তান এসেছিল। কয়েকদিন আগে আমি সন্তানটি নষ্ট করেছি। তারপর থেকে মানসিক পীড়ায় ভুগছি, আমার শান্তি কেড়ে নেয়া হয়েছে। আমার এই কাজটি ইসলাম সমর্থন করে কিনা- তা জানার জন্যই আপনাকে বিরক্ত করলাম! বলুন তো আমার ব্যাপারে ইসলাম কী বলে? এখন আমার করণীয়ই বা কী?’
আলেম বললেন, ‘সন্তান নষ্ট করার কথা বলছেন! এতো অনেক পরের প্রশ্ন। একটি ছেলের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন তো দূরের কথা তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করাই অপরাধ। আর গর্ভজাত সন্তান নষ্ট করা সম্পর্কে আল্লাহ তো কুরআনে স্পষ্টই বলেছেন কিয়ামতের দিন জিজ্ঞেস করা হবে, কোন অপরাধে তাদের হত্যা করা হয়েছিল? (সূরা তাকবীর, আয়াত : ৯)
আপনি এতগুলো স্তর পার করে এসে শুধু সন্তান হত্যা করার অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছেন!
তরুণ আলেমের বিস্ময় দেখে যুগ সম্পর্কে তার ধারণার প্রতি করুণা হলো তরুণীর। তিনি তাকে ততধিক বিস্মিত করে বললেন- ‘হুজুর, এত বিস্মিত হচ্ছেন কেন?। আমাদের সোসাইটিতে ওতো হরহামেশাই ঘটে চলেছে! আমাদের ইউনিভার্সিটির (নাম উহ্য রাখা হলো) শতকরা পঁচানব্বই ছাত্রছাত্রীই তো লিভ টুগেদার করে! আমরা কেউ তো এটাকে সমস্যার কারণ বলে মনে করি না! তবে আমার খারাপ লাগছে গর্ভজাত সন্তানটাকে নষ্ট করলাম বলে। বাচ্চাটির জন্য মায়া হচ্ছে। ইস্, পূর্ব সতর্কতা সত্ত্বেও কীভাবে যে বাচ্চাটি আমার গর্ভে স্থান লাভ করলো আর নিষ্ঠুর হাতে তাকে হত্যা করতে হলো!’
ঘটনা : ২
বর্তমান প্রজন্মের নারীদের প্রতি ক্রমেই আস্থা হারাচ্ছে আমাদের যুবক সমাজ। হয়ত চোখের সামনে ঘটা নানা ঘটনাই তাদেরকে আস্থাহীন করে তুলে থাকবে। বিশেষ করে স্কুলকলেজের ছাত্রীদের কথা বলতেই হয়। অনেককে তো তাদেরকে… বলে বকা দিতেও শোনা যায়। যদিও এতে নিরাপরাধ অনেক মেয়ের ব্যাপারে অন্যায় ধারণা করা হচ্ছে কিন্তু করার কিছু নেই। কয়েকটি লজ্জাজনক ঘটনার পর এধরনের ধারণা পোষণকারীদেরকে খুব বেশি দোষারোপও করা যায় না। বিশেষ করে ইডেন কলেজ আর ভিকারুননিসার মতো বিখ্যাত স্কুল-কলেজগুলোতে যা ঘটে গেল তাতে খোদ অভিভাবকরাই কন্যাদের ব্যাপারে সন্দিহান। সেখানে অন্যকে দোষারোপ করতে যাওয়া কি ইনসাফ হবে?
আমার বন্ধুর বন্ধুর কথা। জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ার ছাত্র তিনি। বয়সে আমার বন্ধুর কয়েক বছরের বড়। হাফেজ মাওলানা হয়ে এখন তিনি অনার্স করছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তীক্ষ্ন মেধা ও সুন্দর মনের অধিকারী এই কলেজ ছাত্রের সঙ্গে আমার বন্ধুর সাক্ষাত ঘটে ঈদুল ফিতরের কোনো এক ছুটিতে। তারপর বগুড়ার বিখ্যাত সাতমাথার অদূরে খোকন পার্কে গল্পের পসরা নিয়ে বসেন তারা। দরকারি-অদরকারি নানা প্যাচালের ভিড় ঠেলে অবশেষে আসে আসল প্রসঙ্গ। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, তা পণ্ডিত মহাশয়, বিয়েথার কী খবর? কথা শুনে কেমন যেন ভাবনার জগতে মিলিয়ে গেলেন কিছু সময়ের জন্য। তারপর বললেন, ‘ভাই, ও কথা আর বলো না। আমার কপালে কি বিয়েথা আছে! কবে কোথায় চাকরি পাবো, তারপর যদি কোনো ‘ভাবি শ্বশুর আব্বার’ দয়া হয় তবেই না বিয়ে!’ বন্ধু বললেন, আরে ওই সব বিনয়ী ডায়ালগ অন্যদের জন্য রিজার্ভ রেখে বন্ধুদের কাছে আসল কথা বলো। বন্ধুদের সাথে ভনিতা চলে?
বন্ধুত্বের কসমের কাছে তিনি হার মানলেন। এবার তার মুখ থেকে সত্য কথাটাই বেরুলো। তিনি বললেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী, আমি কোনো অশিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করতে পারবো না। এদিকে শিক্ষিত মেয়েদের যা দেখছি, তা না বলাই শ্রেয়।’ জোর করে ধরলাম, বলতেই হবে। বললেন, ‘আমি আসলে কোনো মেয়েকে বিশ্বাস করতে পারব না।’ বললাম, এসব অতি ভালোমানুষী উক্তি যত কম বলা যায় তত ভালো। বললেন, ‘ডায়লগ নয়; সত্যি বলছি। আমি তো নিজের কানকে আর অবিশ্বাস করতে পারি না। এই তো কিছুদিন আগেই একদল মেয়েকে বলতে শুনলাম, তারা দেহ ব্যবসা থেকে ফিরে এসে ছেলেদের ওপর ক্রোধ উদ্গীরণ করে বলছে, ‘তোরা আমাদের থেকে যৌতুক নিবি না? নিস্, আমরা যৌতুকই কামাই করছি তোদের জন্য!’ বললাম, দেখেন ভালো-মন্দ সব জায়গায়ই আছে। সবাই তো এক রকম না। বললেন, আমি শুধু নিজের ইউনিভার্সিটির অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, ওখানকার নব্বইজন ছাত্রীরই আছে বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্কের অভিজ্ঞতা। আর আমি যে ওই বাকি দশ পার্সেন্টের একজনকে পাবো তার নিশ্চয়তা দেবে কে? অতএব যেমন আছি তেমনই ভালো!
ঘটনা : ৩
কোনো এক রমযানের ঘটনা। ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে ওঠা ঢাকা শহরে চলাফেরা করা আর দুর্গমগিরি কান্তার মরু পাড়ি দেয়া সমান ব্যাপার হয়ে উঠেছে। রমজান মাস আসলে তা বহুগুণে বেড়ে যায়। ঢাকার রাস্তাগুলো তখন মানুষের কাছে পুলসিরাত পাড়ি দেয়ার মতো কঠিন বলে মনে হতে থাকে। এমনি এক দিনে মানুষ যখন যানজটের জাহান্নামে ভারি ভারি শ্বাস নিচ্ছে তখন দেখা গেল সত্যিকার এক নারকীয় দৃশ্য। ঘটনাটা কাকলীর। গাড়ির ভ্যাপসা গরমে আর মানুষের ঠাসাঠাসিতে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ায় যাত্রীরা গাড়ির জানালা দিয়ে ঘন ঘন বাইরে তাকাচ্ছে। সেই তাকানোতেই ধরা পড়ল ঘটনাটা। মানুষ কৌতূহলী হয়ে উঠল।
অনেকগুলো র্যাবের গাড়ি। র্যাব আর জনতার সংখ্যা হাতে গোনার মতো নয়। ঘটনার মূল নায়ক কয়েকজন ললনা। তারাই সব কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু। দেখা গেল, ‘হোটেল ঢাকা ইন’ থেকে বেরিয়ে আসছেন একদল মুখ আড়াল করা ললনা! পোশাকই বলে দিচ্ছে এরা ঢাকার বিভিন্ন কলেজ-ভার্সিটির ছাত্রী। শিক্ষাঙ্গন আলোকিত করা বাদ দিয়ে তারা কলুষিত করতে এসেছিলেন ঢাকার চেনাজানা কয়েকটি আবাসিক হোটেল। সেখান থেকেই অসামাজিক কাজে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করে থানায় নেয়া হচ্ছে! আহ্! যে ওড়না দিয়ে তারা মুখাবয়ব ঢেকে রেখেছে তা এসব আল্ট্রা মডার্নদের দৃষ্টিতে অন্য সময় তো চক্ষুশূল। কিন্তু আজ কেন তা যক্ষের ধন!
হ্যা, এভাবেই মুক্তবাসের উচ্ছলতা আর যৌবনের পাগলা হাওয়ায় উড়তে থাকা টিনএজাররা রসাতলে যাচ্ছে। চারদিকে চলছে জাতির সবচে মূল্যবান সম্পদ যুব সমাজকে ধ্বংস এবং আদর্শিকভাবে পঙ্গু করার নানা আয়োজন। মুক্তবাস যার পথকে করেছে উন্মুক্ত। পর্দার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী এই সমাজের চিন্তা আর পরিকল্পনার বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে তরুণ-তরুণীদের এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দেয়ার নানামুখী তৎপরতা। একসাথে ক্লাস, একসাথে আড্ডা, একসাথে পরীক্ষা ও একসাথে চলাফেরা। সর্বোপরি লেখাপড়ার অজুহাতে ব্যবধানের সব দেয়াল তুলে দেয়া। সর্বত্র পর্দাহীনতা ও নির্লজ্জতার রমরমা কারবার। আছে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির সম্ভাব্য সব আয়োজন। এদিকে ক্লাসে আলোচনা প্রেম নিয়ে, গল্প-উপন্যাসের আলোচ্য বিষয়ও অভিন্ন। নাটকে-সিনেমায় এবং বন্ধুদের আড্ডাতেও সেই উচ্ছসিত জীবনের মধুর অধ্যায়!
এত কিছুর যোগফলে যখন তরুণ-তরুণীদের স্বভাবজাত বাসনা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, টাইগার-স্পীড খাওয়া টগবগে যুবকরা যখন রিপুর দংশনে ছটফট করতে থাকে, তখন তাদের সামনে পেশ করা হয় প্রতিষ্ঠিত হয়েই বিয়ে করার অমূল্য উপদেশ। ‘এত অল্প বয়সে বিয়ে নয়। মাত্র ত্রিশ বছরে বিয়ে! সে তো গ্রাম্য কালচার! অথচ এই বয়সের লোকদের পবিত্রতা ও চরিত্র সংরক্ষণের তাগিদ দেয়া হয়েছে তীব্রভাবে। সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিআল্লাহু ‘আনহু এই সময়ের সমস্যার কথা ব্যক্ত করলেন এভাবে-
كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ شَبَابًا لَا نَجِدُ شَيْئًا
আমরা কিছু যুবক ছিলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর সময়ে যারা বিবাহ করার মতো আর্থিক সামর্থ্য রাখতাম না। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ ؛ مَنْ اسْتَطَاعَ مِنْكُمْ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ ، وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ ، فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ
হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা সামর্থ রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা এটা দৃষ্টির হেফাযত এবং লজ্জাস্থান পবিত্র রাখার সর্বোত্তম উপায়।’ [বুখারী : ১৯০৫]
কিন্তু আমাদের সমাজ চলছে উল্টোস্রোতে। উন্মত্ত যুবককে যৌবনের সূচনাকালে নিবৃত রাখা হয় নাবালেগ বলে আর পূর্ণযৌবনে আটকে রাখা হয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা বলে। তাহলে অধপতিত এই সমাজের চারিত্রিক অবস্থা ধরে রাখার উপায় কী?
আগুনের কাজ দহন করা। এটা তার ধর্ম। ভিন্ন যুক্তি বুঝিয়ে তো বস্তু বা কোনো সত্তার স্বীয় ধর্ম বদলানো যায় না। যৌবনের ধর্মও তো বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া। বিপরীত লিঙ্গকে কাছে পেতে যা দরকার তা-ই করা। এত কিছুর মাধ্যমে তরুণ-তরুণীদের সহজাত যৌন লালসাকে উস্কে দেয়া হচ্ছে ঠিক। কিন্তু এ প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের বৈধ দরজা আটকে রাখা হয়েছে শক্ত খিল দিয়ে।
বাল্য বিয়ে ঠেকাতে গিয়ে যৌবনের বিয়ে ঠেকানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। এমনকি আইন করে ঘোষণা করে হচ্ছে, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলে-মেয়ে শিশুই থাকে! কথাটা একেবারেই ফালতু। আজকের এই যুগে ১৮ বছরেও কেউ শিশু থাকে একথা শুনে শিশুরাও খিলখিল করে হাসবে!
স্বাভাবিক পথে বৈধ কাজ করলে নিন্দা কুড়াতে হয়। তিরস্কার ও ভর্ৎসনা সহ্য করতে হয়। অথচ চোরাইপথে অন্যায় করলেও তাতে দোষের কিছু নেই! এমনই যে সমাজের নিয়ম সেখানে আর শান্তি থাকে কী করে। যা হবার তাই হচ্ছে। আগুন নিভছে না। আরও উত্তপ্ত হচ্ছে। বিবাহপূর্ব ভালোবাসা, লিভ টুগেদার ও পরকীয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে। অহরহ জ্বলছে সুখের ঘরে দুখের অনল। পাপে তো বাপকেও ছাড়ে না। এরা পাপ করতে করতে হারিয়ে যাচ্ছে পাপের চোরাগোলিতে। এসব বখে যাওয়া ‘সন্তানকে নিয়ে অভিভাবকরা যে কী বিপদে আছেন, তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। তবে ভাবার তালিকায় কিন্তু মুক্তবাসের কুফলটাই আগে থাকা চাই!
পাপের অনুভূতি ধীরে ধীরে এত ক্ষীণ হতে চলেছে যে, এখন ভদ্র ঘরের মেয়েরাও ইদানীং অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এসব কথা কী ঘটনা হাতেনাতে না ধরা পর্যন্ত বিশ্বাস করা যায়! বেশ কয়েক বছর আগে র্যাবের অভিযানে ইয়াবা সুন্দরীরা একের পর এক ধরা পড়েছিল। অভিজাত পাড়ার কান্তদর্শন যুবক-যুবতীদের মন্দদর্শন কীর্তিকলাপ মিডিয়ায় আসতে শুরু করেছিল। সবাই তখন বিস্মিত স্তম্ভিত হয়েছিলেন। অবস্থার কিন্তু উন্নতি হয় নি। অবনতিই হয়েছে ক্রমশ। সন্ধ্যার পর যদি দুর্ভাগ্যক্রমে আপনাকে কোনো কলেজ-ইউনিভার্সিটির আশপাশের রাস্তা দিয়ে যেতে হয়, তাহলে কারও পক্ষ হতে চোখে আঙুল দেয়া ছাড়াই নিজেই দেখতে পারবেন আমাদের টিনএজাররা কোন পথে তাদের সহজাত চাহিদা মেটাচ্ছে। হুডফেলা রিকশায় উন্মত্ত তরুণ-তরুণীদের অশোভন আচরণ দেখে আপনি কি একথা ভেবে অবাক হন না যে, এদের নিয়েই তাদের পরিবারের লোকেরা স্বপ্ন দেখে? আমরাও এদেরকে ভবিষ্যতের সম্বল বলে মনে করি? কেউ হয়ত কলেজ-ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিয়ে এসব লেখায় আমার প্রতি রুষ্ট হবেন। কিন্তু এই লেখা তো এই প্রথম নয়। সেই ছাত্র যমানাতেই আমরা ‘ভার্সিটির মেয়েরা’ বইটিতে এসব করুণ উপাখ্যান পড়ে আফসোস করার অভ্যাস করে এসেছি। কিন্তু সেই লেখা আর এই লেখার মধ্যে পর্বতপ্রমাণ পার্থক্য নিহিত। এই লেখা তো জাগ্রত করার জন্য, এখানে দ্বেষ-বিদ্বেষের কোনো প্রশ্ন নেই। আছে কল্যাণকামিতা, মঙ্গলের প্রত্যাশা। দ্বীন হচ্ছে কল্যাণকামিতার নাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন –
«الدِّينُ النَّصِيحَةُ»
দ্বীন হচ্ছে কল্যাণকামীতার নাম।’ [মুসলিম : ৫৫]
এতএব সেই কল্যাণকামিতার উৎস থেকে কোনো লেখা আসলে সেই লেখাকে কি উপেক্ষা করা যায়?
একটু ভেবে দেখুন প্রথম ঘটনার কথা। ব্যভিচার কতোটা ব্যাপকতা পেলে এমন উক্তি করতে পারে একটি মেয়ে? ব্যভিচারের দিকে ইঙ্গিত করে বলছে, ‘ও তো হয়েই থাকে। ও কোনো সমস্যা না।’ আর দ্বিতীয় ঘটনায় এক আল্লাহভীরু যুবক যা বলেছেন তা শুধু এক খোকনেরই উক্তি নয়। যারা নির্লজ্জতায় গা ভাসিয়ে দিতে পারেন না, এরকম হাজারও সচেতন যুবকের কথা এগুলো। যিনা-ব্যভিচার এতো বৃদ্ধি পেয়েছে যে, মেয়েরা ছেলেদের কাছ থেকে কামাই করে ছেলেদের যৌতুক দেয়ার কথাও সদম্ভে ঘোষণা করছে! তৃতীয় ঘটনায় আমরা দেখতে পাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ার অবিশ্বাস্য চিত্র। অবশ্য যারা পত্র-পত্রিকা পড়েন তারা জানেন, ঢাকার বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের এ ধরনের নিকৃষ্টকর্মে জড়িয়ে পড়ার খবর বিরল নয়।
সময় হয়েছে ভেবে দেখার কেন এসব হচ্ছে। সেই সাথে প্রতিরোধের চিন্তাটাও করতে হবে যত্নসহকারে। সবার মধ্যে, বিশেষত টিনএজারদের মধ্যে দ্বীনদারি ও আল্লাহভীতির প্রভাব বাড়ানো ছাড়া যৌবনের এই পাগলা ঘোড়াকে থামানো সম্ভব নয়। তরুণ-তরুণীদের দেহ-মনের সুস্থতা ও ক্রমান্নতি ধরে রাখতে ইসলামেই রয়েছে সবচেয়ে সুন্দর ও সাবলীল দিকনির্দেশনা। সমাজে আল্লাহর ফরজ বিধান পর্দার চর্চা বাড়াতে হবে, তরুণ-তরুণীদের দৃষ্টি অবনত রাখতে হবে, প্রাপ্ত বয়স্কদের আর্থিক ও দৈহিক সামর্থ্য থাকলে দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে এবং যাদের সামর্থ্য নেই তাদের রোজার মাধ্যমে আপন জৈবিক চাহিদাকে সাময়িকভাবে দমিয়ে রাখতে হবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
«مَنِ اسْتَطَاعَ البَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ، وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ، فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ»
‘হে যুবসমাজ! তোমরা যারা সামর্থ্য রাখো, তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হও। যারা সামর্থ্য রাখো না, তারা রোজা করো। কেননা তা প্রবৃত্তিকে দমিয়ে রাখে।’ [বুখারী : ১৯০৫; মুসলিম : ১৪০০]
﴿وَأَنكِحُواْ ٱلۡأَيَٰمَىٰ مِنكُمۡ وَٱلصَّٰلِحِينَ مِنۡ عِبَادِكُمۡ وَإِمَآئِكُمۡۚ إِن يَكُونُواْ فُقَرَآءَ يُغۡنِهِمُ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦۗ وَٱللَّهُ وَٰسِعٌ عَلِيمٞ ٣٢ وَلۡيَسۡتَعۡفِفِ ٱلَّذِينَ لَا يَجِدُونَ نِكَاحًا حَتَّىٰ يُغۡنِيَهُمُ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦۗ ٣٣ ﴾ [النور: ٣٢، ٣٣]
‘আর তোমরা তোমাদের মধ্যকার অবিবাহিত নারী-পুরুষ ও সৎকর্মশীল দাস-দাসীদের বিবাহ দাও। তারা অভাবী হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও মহাজ্ঞানী। আর যাদের বিবাহের সামর্থ্য নেই আল্লাহ তাদেরকে নিজ অনুগ্রহে অভাবমুক্ত না করা পর্যন্ত তারা যেন সংযম অবলম্বন করে।’ {সূরা আন-নূর : আয়াত ৩২-৩৩}
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে সঠিক পথে চলার এবং ইহ ও পরকালীন কল্যাণ অর্জনের তাওফিক দিন। মুক্তবাসের অকল্যাণ আর ক্ষতির দিক চিন্তা করে তা থেকে দূরে থাকার হিম্মত দিন। আমিন (আলী হাসান তৈয়ব, যৌবনের মৌবনে, সূত্র : মাসিক রাহমানী পয়গাম)
The post মুক্তবাসের শিক্ষালয়! সহ শিক্ষার কুফল appeared first on Amar Bangla Post.